প্রেমের দৃশ্য নয়, পর্নো ভিডিও দেখতে ভালোবাসি!
প্রেম। শব্দটি বলা মাত্র, কেন জানি এ উত্তর আধুনিককালেও, লোকের সামান্যতম হলেও গাত্রদাহ হয়। প্রেম সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ভাব ও ভাবনা লোকের মধ্যে রয়েই গেছে। অত না আধুনিক, হাতে স্মার্টফোন, কিন্তু প্রেম কথাটি শুনলেই, এই সময়ে বসেও মধ্যযুগে যাপন করতে চাই জীবন। মেনে নিতে পারি না প্রেমকে। মনে করি, প্রেম নষ্টামি। তাই প্রেমের দৃশ্যায়ন বা চিত্রায়ন দেখলেও আপত্তি করি।
কুসুম শিকদারের মিউজিক ভিডিওটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে তোলপাড়। অশ্লীল! অশ্লীল! অশ্লীল!- বলে মুখে ফেনা তুলেছেন অনেকেই। অনেকে আবার বলছেন, এত খোলামেলা দৃশ্য নাকি আগে কখনও দেখেননি। কেউ কেউ বলছেন, কুসুম শিকদার মেয়েটা অসভ্য, লাজ শরমের বালাই নেই, অভাবে খোলে কেউ কাপড়!
সাধারণত মিউজিক ভিডিও আমার দেখা হয়ে উঠে না। কেউ রেফার করলে বা কাজের প্রয়োজনে দেখতে হলে দেখা হয়। আবার খুব ভালো করেছে, বলছে সবাই তখন অথবা লোকে খুব মন্দ বলছে, গাল দিচ্ছে, ঢিঢি করছে তখন দেখা হয়,‘সোস্যাল পারসেপশনটা’ বুঝবার জন্য। কুসুমেরটাও তাই।
কী আছে ওতে, অত গালমন্দ করছে কেন কিছু লোকে? পরে দেখলাম এই মিউজিক ভিডিওর বিতর্ক আদালত অবধি গড়িয়েছে। গানটির প্রকাশক ‘বঙ্গ’সহ মডেল কুসুম শিকদার ও খালেদ হোসাইন সুজনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আফতাব উদ্দিন ছিদ্দীকী রাগিব। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান, তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য সচিবকেও পাঠানো হয়েছে নোটিশ। দাবি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওটি সরাতে হবে। অন্যথায় ভিডিওটির সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা।
অভিযোগকারী বলছেন, ভিডিওটির কাভার ছবিও অত্যন্ত অশ্লীল ও আপত্তিকর। গানের কথা নিয়েও রয়েছে ‘উত্তেজনা’র অভিযোগ। দৃশ্যায়নে শাওয়ারের, সুইমিংপুলের, শয্যার ও চুম্বন দৃশ্যেও আপত্তি তোলা হয়েছে। আপত্তি রয়েছে মিউজিক ভিডিওটির ‘নেশা’ নামেও।
কুসুমের ভিডিওটি আমার কাছে মোটেও অশ্লীল মনে হয়নি। বরং অনেক বেশি নান্দনিক, সৃজনশীল আর শৈল্পিক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, নেহাত প্রেম ও বিরহকাতরতার দৃশ্যায়ন এটি। দয়িতা তার প্রেমিকের জন্য বিরহকাতরকাল যাপন করছে। গানের মুখটাতেই বলা আছে- জানি না সে কেন ভুলে গেল, চলে গেল/ জানি না কেন/ ধুপছায়া রাতে জোনাকির জলসা ছেড়ে হারিয়ে সে গেল/ জানি না কেন। গানের মাঝে মাঝে প্রেমের টুকরো স্মৃতি, আবেগঘন কিছু দৃশ্যচিত্র ভেসে উঠে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার অদ্ভুত মিশেল, ফুটে উঠেছে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফিতে। কুসুম ও খালেদ দু’জনের অভিনয় ও প্রশংসাযোগ্য।
মনে রাখতে হবে, প্রেম আসলে একধরনের ‘ঘোর’ই, কোন স্বাভাবিক অবস্থা নয়। প্রেম একটি বিশেষ অবস্থা। ফরাসি মনোবিদ ও দার্শনিক জ্যাক লাকাঁন বলেছেন, লাভ ইজ আ ল্যাভেরিন্থ। অর্থাৎ প্রেম একটা গোলকধাঁধা। শুধু তাই নয়, তিনি আরো বলেছেন, প্রেমে পড়ে মানুষ পথ হারায় এবং নিজেকেও হারায়। প্রেমের প্রাথমিক বা শুরুর পর্যায়টি কিন্তু তাই-ই। নিজেকে শূন্যে হারাবার।
আর আবেগময় দৃশ্য নিয়ে লোকের অত আপত্তি কেন? আবেগই যদি না থাকে তবে সেই প্রেম কেমন প্রেম? আবেগহীন প্রেম তো প্রেম নয়, কেবল মেকানিক্যাল ‘কাম’ এর উপলক্ষ্য মাত্র। যদিও সরাসরি কোন চুম্বন দৃশ্য ভিডিওতে নেই, তবুও অনেকের ‘চুম্বন ঘটতে যাচ্ছে’ এমন সম্ভাব্য দৃশ্যেই আপত্তি। আমার তো মনে হয় যেকোন প্রেম আখ্যানে, চুম্বন দৃশ্য অপরিহার্য।
ইউরোপ নয়, যদি নিজেদের সাহিত্যের দিকে তাকাই তবে দেখবো ‘মঙ্গলকাব্য’ জুড়ে রয়েছে এমন অসংখ্য প্রেমনাট্য। ময়মনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে, ভাঁজে ভাঁজে প্রেম কাতরতা, বিরহকাতরতা। মহুয়া, মলুয়া, কাঞ্চনকন্যা, দেওয়ানা মদিনা, পদ্মাবতী- কোথায় নেই এমন প্রেমকাতরতা। আজকের দিনে সে সবেরও যদি দৃশ্যায়ন হতো, সেখানেও এমন আবেগঘনিষ্ট দৃশ্যই দাবি করতো।
আসলে আমাদের রুচি বিকৃতি ঘটেছে। আর যৌনরুচি তো আরো ভয়াবহ। আমাদের কাছে চুম্বন দৃশ্য অশ্লীল মনে হয়, কিন্তু কামড়ের দৃশ্য শালীন মনে হয়। প্রেম আমাদের কাছে অস্বাভাবিক, ধর্ষণ, যৌন হেনস্তা, যৌন নির্যাতন স্বাভাবিক। ইউটিউবে অনেকবার, অনেক বেশি দর্শক দেখেছেন, অমন সব ভিডিওর বেশির ভাগই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ‘লাভমেকিং’-এর নয়, নেয়াত ‘সেক্সুয়ালটর্চার’ এর ভিডিও। আমাদের যৌন রুচি দিন দিন পর্নো রুচিতে পৌঁছুচ্ছে। আমরা প্রেমের দৃশ্য নয়, পর্নো ভিডিও দেখতে ভালোবাসি।
সময় বদলেছে, চিন্তা বদলায়নি। আধুনিক সেলফোন হাতে, কিন্তু আমরা রয়ে গেছি সনাতন, সেকেলে, অনাধুনিক। এখনও প্রেম অনেকের কাছে অশালীন, কিন্তু আমার কাছে তা শালীন, শোভন চিরকালই। যদি তা সত্যিই অন্তরনিষ্ঠ প্রেম হয়। আমি নিজেও ভীষণ প্রেমপ্রবণ মানুষ। মানুষ প্রেমে পড়ুক, প্রেম গড়ুক- নারী-পুরুষের সঙ্গে, পুরুষ নারীর সঙ্গে, পুরুষ পুরুষের সঙ্গে, এমনকি নারী নারীর সঙ্গেও। প্রেমে কোনদিনও অশালীনতা নেই।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]
এইচআর/পিআর