ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সম্পদ বণ্টনে লিঙ্গ বৈষম্য আর কতদিন?

প্রীতি ওয়ারেছা | প্রকাশিত: ০৪:১৭ এএম, ১৬ আগস্ট ২০১৭

আমার খুব কৌতূহল হয় জানতে, সন্তান জন্মদানের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ের কার্যকলাপকালে কোন নারী-পুরুষকে তাদের ছেলে সন্তানের তুলনায় মেয়ে সন্তানের জন্যে কম এফোর্ট দিতে হয়েছে কীনা! অথবা, সন্তান ছেলে-মেয়েভেদে মায়ের গর্ভকালীন ও জন্মদানকালীন কষ্টের তীব্রতার কোনরকম হেরফের হয় কীনা! জানতে ইচ্ছে করে, সন্তান ছেলে-মেয়েভেদে মা-বাবা নিজেদের প্রতি সন্তানদের ভালোবাসার কোন তারতম্য লক্ষ্য করেন কীনা! আমার ধারণা যেসব মা-বাবার ঘরে ছেলে ও মেয়ে দুই রকমের সন্তানই আছে তারা এসব তুলনাবাচক মতামত ভালো দিতে পারবেন। শুধু মতামত কেন, জবাবদিহিও করতে হবে!

নিজের খায়েসে কন্যাসন্তান জন্ম দেবেন, তাকে প্রতিনিয়ত পারিবারিক অবহেলার মাঝে বড় করে বিষণ্ন ও আত্মমর্যাদাহীন মানুষরুপে গড়ে তুলবেন এবং মা-বাবা হয়েও একসময় তাকে এই পৃথিবীর অনিশ্চিত জীবনযাত্রার মাঝে ছেড়ে দেবেন সেই অধিকার কিছুতেই আপনারা রাখেন না। নিজেরা কন্যা সন্তানকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা দিতে পারেন না, আর দেবে দেশের আইন! আইন বড়জোর নিয়ম বেধে দিতে পারে, সেটা ভাঙলে শাস্তি দিতে পারে, ভালোবাসা আর বিবেক কী জাগাতে পারে! মুসলিম পরিবারের একটা ছেলেশিশুকে জন্মের পরপরই অভিনন্দিত করা হয় আজান পরিবেশনের মাধ্যমে, কন্যা শিশুর বেলায় সেই ব্যবস্থা নাই কারণ কন্যা কারো আরাধ্য নয়।

অন্যান্য ধর্মীয় আচারেও রয়েছে যার যার মত করে ছেলে শিশুকে অভিনন্দিত করার রেওয়াজ। এখানে আমি কিন্তু বলছি না আজান দিতেই হবে কিংবা ধর্মীয় আচার মেনে কন্যা শিশুর জন্যেও অভিনন্দন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে, বলছি ছেলেশিশুকে সর্বান্তকরণে আরাধ্য প্রমাণের এই কুটিল প্রক্রিয়ার প্রভাব সমাজের জন্য ভীষণভাবে নেতিবাচক। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সাধন' এর উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের একটি সনদ এর নাম সিডও। Convention on the Elimination of All forms of Discrimination against Women (CEDAW) । সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের স্বীকৃতি এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্ষমতায়নের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণ এই চুক্তির উদ্দেশ্য। সিডও সনদে ৩০ টি ধারা রয়েছে। এর ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী-পুরুষের সমতা-সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।

বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। তবে এখানেও আছে সূক্ষ্ম ঘাপলা। স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে এই উপমহাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সিদ্ধহস্ত। সিডও চুক্তি স্বাক্ষরকালে ৩ টি ধারার ৪ টি উপধারা সম্পর্কে সংরক্ষণমূলক নীতি অবলম্বন করে বাংলাদেশ। ধারাগুলো হচ্ছে-২, ১৩.১ (ক), ১৬.১ (গ), (চ)। এই ধারাগুলোর বাস্তবায়ন দীর্ঘসময়সাপেক্ষ কিংবা বলা যায় অনেকটাই অনিশ্চিত।

ধর্মীয় আইনের বাস্তবায়ন বাতিল করে সিডও নির্ধারিত সমন্বিত আইনের মাধ্যমে একজন নারী পুরুষের সমান সম্পদের অংশীদারিত্ব লাভ করুক সেটা কোন ধর্মের অনুসারী পুরুষই চাইবে না। একারণেই সংরক্ষণমূলক নীতি পাকাপাকিভাবে নারীর প্রতি বৈষম্য আরোপের একটি পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক চাল। নিয়মিত খাওয়া, টয়লেট করা এবং বাঁচতে হলে উপার্জন করতে হবে অলিখিত এই বাধ্যবাধকতার চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধর্মচর্চাকে মানবজীবনের অবশ্যপালনীয় একটি বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনে ধর্মের কার্যকারিতা থাকুক আর না থাকুক স্বার্থ সিদ্ধিতে ঠিকই আছে। যে পুরুষটি জীবনে কখনো কুরআন, হাদিস, গীতা, বাইবেল হাত দিয়ে ছোঁয়নি, যার ইত্যবছরের যাপনে কখনো ধর্ম কোন কাজেই লাগেনি সেও ঠিকঠাক জানে ধর্মীয় আইন মোতাবেক তার বোনের সম্পদের অধিকার কতখানি! সম্পদ বণ্টনজনিত ধর্মীয় আইন সবার মুখস্থ।

পারিবারিক বিষয়ে সমন্বিত আইন না থাকায় বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ ও সম্পদ বণ্টনের মত পারিবারিক বিষয়াদি মুসলিম আইন, খ্রিস্টান আইন ও হিন্দু আইনের দ্বারা ঐসব ধর্মের অনুসারীরা পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিটি ধর্মীয় পারিবারিক আইনেই নারীর প্রতি চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। আর এই ধর্মীয় আইনের নাগপাশ থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া খুব সহজ না। প্রসঙ্গত দীর্ঘদিন ধরে চলা পারিবারিক সমন্বিত আইন বাস্তবায়নের আন্দোলন তাই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। নারীর প্রতি বৈষম্য আর উপেক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠিত জায়গা হল তার পরিবার। শুধুমাত্র ধর্মে বর্ণিত আছে বলেই যুগ যুগ ধরে মা-বাবা তাদের নিজ সন্তানের লিঙ্গভিত্তিক উৎকর্ষ ও বৈষম্যমূলক ভাগ্য রচনায় বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ধর্মে নিষিদ্ধ আছে এমন অসংখ্য বিষয়কে উপেক্ষা করা যায়, গোপনে ধর্মের নিষিদ্ধকার্য সম্পাদন করা যায় কিন্তু সম্পদ বণ্টনে ধর্ম অমান্য করা একেবারে নাজায়েজ কর্ম।

ধর্মীয় আইনের কারণে সন্তান কখনো পূর্ণাঙ্গ, কখনো অর্ধেক আবার কখনো শুধুমাত্র 'অমুকের কন্যা' নামধারী। অমুকের কন্যারা শুধুমাত্র বাড়িতে প্রতিপালিত হয়, কোন সম্পদের অংশীদারিত্ব লাভ করে না। মা-বাবা স্বার্থপর বলেই সন্তানের এমন বিভিন্ন আঙ্গিক সমাজে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মা-বাবা চায়নি বলেই কন্যা সন্তান তাদের কাছে কখনোই পূর্ণাঙ্গ সন্তান হয়ে ওঠতে পারেনি! মা-বাবা যৌথ আনন্দিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুত্র-কন্যাকে পৃথিবীতে আনেন, পুত্র-কন্যাভেদে দুই সন্তানের মুখে একরকম ডাক শোনেন, এরপর একই বাড়িতে দুইজনের প্রতি ভিন্ন কর্তব্য প্রদর্শনপূর্বক লালনপালন করেন, ভিন্ন অধিকারবোধ ঢুকিয়ে উৎকৃষ্ট ও নগন্য হওয়ার শিক্ষা দেন এবং জীবনের শেষে কিংবা মৃত্যুর পরে ধর্মীয় ওজিফা অনুযায়ী দুই সন্তানের প্রতি ভিন্নতর সম্পদের ভালোবাসা বণ্টন করেন। অথচ কন্যাটি কিন্তু তার মা-বাবার জিন থেকেই তৈরি হয়েছিল তাদের পুত্রসন্তানটির মতোই।

এই সমাজ কন্যাশিশুকে ফ্রক পরিয়ে, পুতুল খেলতে দিয়ে, ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত রেখে তাকে ধীরে ধীরে নারীতে পরিণত করে। "কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। তাকে নারী করে তোলা হয়…” সিমন দ্য বুভেয়ারের অসামান্য এই পর্যবেক্ষণের সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগই নেই। এই সমাজ শিশুকালেই একজনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে দেয় মানুষের মত প্রতিটা কাজেরও লিঙ্গ পরিচয় আছে। একটা ছেলেশিশু শিশুকাল থেকেই জেনে যায় রান্না থেকে শুরু করে আরো অনেকগুলো কাজ তার করা সাজে না কারণ সে হচ্ছে পুরুষ।নারী পুরুষের সামাজিক এই তফাতিকরণের চালচিত্র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমলা ভাসিন বলেছিলেন, নারী যদি রান্না করতে পারে তবে একজন পুরুষও পারবে কারণ নারী তার জরায়ু দিয়ে রান্না করে না।

বিয়েকে এই সময়ে এসেও নারীজীবনের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হিসেবে ধরা হয়।

কন্যাকে বিয়ে দিয়ে পরিবারের বোঝা নামানো হয় বা ঝামেলা চুকানো হয়। সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়া সম্পদ বণ্টনের আগে সবসময় বিবেচনা করা হয় পরের ছেলে (মেয়েজামাই) সম্পদ খাবে তারচেয়ে বরং সম্পদ ঘরের ছেলের কাছেই থাকুক। অতএব ধর্মীয় আইনে বর্ণিত পরিমাণটুকু থেকেও নারীকে বঞ্চিত করা হয়। সবরকম ধর্মীয় আইন ও রাষ্ট্রীয় আইনজনিত বৈষম্য ও বিভ্রাটের বাইরে থেকে আমি আমার দুই সন্তানের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আর কারা চান?

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন