শোকের পোস্টারে ভোটের ঘ্রাণ
অভিজাত কফিখানায় যাবার অভ্যেস নেই। নিমন্ত্রণ পেলেও সাহসে কুলোয় না। যদি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সেই কফিখানাতে গিয়েও ঘামে ভিজে যাই! তারপরও মাঝে মধ্যে দাপ্তরিক কারণে যেতে হতো বাধ্য হয়ে। সেদিনও গেলাম। একজনের দাওয়াতে। যানজট সাঁতরে যখন পৌঁছি, দেখি তিনি আসর জমিয়ে বসেছেন। সরকার দলীয় নেতা বলে দাবি করেন। লোকে অবশ্য বলে হবু নেতা। তবে বেশভূষাতে তিনি নেতা বনে গেছেন বলা যায়। চুলের ভঙ্গিও তেমন। বুকে নৌকা প্রতীক। এই প্রতীকের জাদুতে তিনি আড্ডায় তরতর করে সিঁড়ি পার হয়ে যাচ্ছেন।
রকমারি কমিটির সভ্য, সভাপতি থেকে শুরু করে মন্ত্রীর চেয়ারে বসারও স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন। আসরের মোসাহেবরা তাতেই জো আচ্ছা, জো আচ্ছা বলে ধুয়ো তুলছেন। খুব দ্রুতই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন সেই হবু নেতাটি। প্রশ্ন রাখতে থাকলেন- আওয়ামী লীগের কয়েক জন পরীক্ষিত নেতার মুক্তিযুদ্ধের অবদান নিয়ে। কথায় কথায় নিজেকে বঙ্গবন্ধু সৈনিক বলে দাবি করলেও, তার আচরণ বরং আওয়ামী লীগের যে কোন কর্মীর জন্যই বিব্রতকর। তিনি আগামী ভোটের টিকেট পকেটে গুঁজেই রাজা-উজীর মেরে যাচ্ছেন, এমনটাই তার দাবি। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, আগলে রেখেছিলেন তাঁর আদর্শ এই হবু নেতা তুড়ি মেরে সেই সৈনিকদের উড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি দেখছি তার বচন ও দামি সিগারেটের ধোঁয়ায় কিভাবে দূষিত হচ্ছে সৃজনশীল রাজনীতি। তৃণমূলের রাজনীতিতে কিভাবে পড়ছে নগরের আস্তরণ।
ঐ আভিজাত কফিখানা থেকে বিষণ্ণ মনে অফিসে ফিরছিলাম। শ্রাবণে ভেজা শহর। ক্ষতবিক্ষত পথ, নোনা ধরা দেয়াল দেখছিলাম। নোনাধরা দেয়াল কখনো কখনো নস্টালজিক করে তোলে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় পূর্বের দিন গুলোতে। নোনা ধরা দেয়ালে পোষ্টার লাগালে, তা আপনাতেই ওঠে আসতো। সিনেমার কতো পোস্টার এভাবে তুলে নিয়েছি। নোনাধরা দেয়ালে পোস্টার সাঁটানোর অভিজ্ঞতাও আছে। সেই দিন গুলোতে ফিরে যেতে দেখি দেয়াল জুড়ে আছে পোস্টার। ফ্লাইওভারের দখল নিয়েছে পোস্টার। আগস্ট পেরোচ্ছি। ১৫ আগস্টের দিন কয়েক বাকি। দেয়ালের পোস্টার শোক দিবসকে উপলক্ষ্য করে হলেও, সেখানে ম ম করছে ভোটের গন্ধ। যে নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধুর ছবি অতিক্ষুদ্র ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে নামে মাত্র। পোস্টারের জমিন জুড়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবি, তাদের নির্বাচনী এলাকার নাম বড় বড় হরফে লেখা। আবার ভোট প্রার্থীদের বাইরেও নয়া গজানো নেতারও নিজেদের প্রতিকৃতি দিয়ে পোস্টার ছেপেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্য চিমটি খানিক জায়গা বরাদ্দ। এই দৃশ্য যে কেবল রাজধানীতে তা নয়, দেশজুড়েই চলছে এমন শোক বাণিজ্য।
এই শোক বাণিজ্য নিয়ে কথা হচ্ছিল আওয়ামী লীগের একজন তরুণ নেতার সঙ্গে। তিনি ধাপে ধাপে তৃণমূল সংগঠন থেকে ওঠে আসছেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- দেখেন আমরা রাজনীতি করার জন্য সংগঠন করছি। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর আদর্শ আমাদের প্রণোদিত করেছে রাজনীতি করতে। কিন্তু আপনি যাদের কথা বলছেন, যারা বুকে নৌকা প্রতীক নিয়ে ঘুরে বেড়ান, বঙ্গবন্ধু এবং দলের প্রতি তাদের এই দৃশ্যমান ভালবাসার আড়ালে ব্যবসার টঙ্কার বাজে। তারা কেউ এসে দলে ভিড়েন ব্যবসার সুরক্ষার স্বার্থে, আর কেউ আসেন ব্যবসা ধরতে। এই দুইপক্ষের চাপে বঙ্গবন্ধুর অর্গানিক সৈনিকেরা এখন চিড়ে চ্যাপ্টা। তাদেরই বরং এখন আদর্শের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী এমন সৈনিকদের কাছে। এ বড় লজ্জার, শোকেরও।
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি।
এইচআর/জেআইএম