ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তিন অঙ্গের সমন্বয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৬:৩৮ এএম, ১২ আগস্ট ২০১৭

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই একটা কথা বলা হয় যে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেনা নির্বাহী বিভাগের কারণে। এবং এই নির্বাহী বিভাগ মূলত রাজনৈতিক সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে সবকিছুতে খবরদারি করে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিও নানা সময় একথা প্রচার করেছে যে, বিচার বিভাগ প্রভাবিত। কিন্তু বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সাথে এখনকার স্পষ্ট দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও বলে যে, বিচার বিভাগ আসলে স্বাধীন।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের যে রায় এসেছে তাতে মামলার মূল বিবেচ্য বিষয়ের বাইরে দেশের রাজনৈতিক ঘটনা ও পূর্বাপর নানা সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, মতামত ও মন্তব্য আসার পর সরকারই বড় ধরনের চাপে পড়েছে।বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালানার তিনটি অঙ্গ আইন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ৷ রাষ্ট্র বনাম মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের পহেলা নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হয়৷ সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে দেয়ার পর দ্বন্দ্বটি প্রকাশ্যে চলে এসেছে৷ মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্যগণ এবং প্রধান বিচারপতি এখন এ নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলছেন৷ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা হচ্ছে৷ গত বছর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়েও তিনি এ নিয়ে অনেক প্রকাশ্য মন্তব্য করেছেন৷

যে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তার মধ্যে ভয়ংকর রাজনীতি আছে। শাসকদল আঘাত প্রাপ্ত হওয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। আর বিএনপি’র অতি উল্লাস প্রমাণ করে তারাও আসলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, তাদের কাছে রাজনীতিটাই মুখ্য। বিএনপি’র উল্লসিত ভাব দেখে তাই প্রধান বিচারপতিকে বলতে হয়েছে, তারা সরকার বা বিরোধী দল, কারো ফাঁদে পা দিতে চান না। রায় ঘোষণার নয়দিন পর সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায়ও কিছুটা সংযম দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন, সেই যুক্তি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে রায়ের সঙ্গে দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল। তিনি বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সংসদ বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়নি।

রাষ্ট্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র সচল থাকে। এই তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সুসম্পর্ক সবসময় প্রত্যাশিত। সব সময় সব দেশে এই তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সুসম্পর্ক বজায় থাকে এমনটাও বলা যাবে না। কখনো ভুল বোঝাবুঝি হলে তার সমাধানের জন্য পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে তা দূর করা উচিত। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর এই তিন বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্যের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতা, মন কষাকষি যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তা কারো কাম্য নয়।

স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দি পর যে মৌলিক ত্রুটি উচ্চারিত হচ্ছে তা সমাধানের দায়িত্ব প্রধানত নির্বাহী বিভাগের। সংবিধানে প্রতিটি বিভাগের কার্যপরিধি কতটুকু এবং সীমারেখা কত দূর পর্যন্ত, তার স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ নিজ নিজ ক্ষমতাচর্চার ক্ষেত্রে জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখে কতটা সেটাই বিচার্য।

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রবর্তনের সময় সংবিধানের অধীনে নির্বাহী বিভাগ হচ্ছে সংসদীয় নির্বাহী বিভাগ। যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল নির্বাহী ও আইনসভার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ। সংবিধানের চতুর্থ ভাগে স্থান পেয়েছে রাষ্ট্রপতির যোগ্যতা তার পদের মেয়াদ, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়সহ নির্বাহী বিভাগ, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সম্পর্কে আলোচনা। নির্বাহী বিভাগ ছিল দু’টি অংশে বিভক্ত, পরোক্ষভাবে নির্বাচিত একজন আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান এবং ক্ষমতাবান একজন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিপরিষদসহ যৌথভাবে জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ।

প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ও তাকে সহায়তা করবে মন্ত্রিপরিষদ। মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রেত সময়কালের জন্য নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাহীব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এতে নির্বাহী কর্তৃত্ব যায় রাষ্ট্রপতির হাতে। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। প্রধান নির্বাহী এবং সংসদ অধিবেশনে ভাষণের মাধ্যমে সংসদের অধিবেশনের উদ্বোধক এবং তা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতার অধিকারী। নবম সংশোধনীর মাধ্যমে আরো বেশি মার্কিন রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার মতো করা হয়। দেশের রাষ্ট্রপতিকে আরো ক্ষমতাধর করে তোলা হয়।

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে আবার সংসদীয়ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধৃত সব বৈশিষ্ট্যই এখানে বহাল রাখা হয়। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য নতুন কিছু ব্যবস্থা সংবিধানভুক্ত হয়। সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা আরো সীমিত করার জন্য ৭০ অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। এ অবস্থায় এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরের গণতন্ত্রের অভাব প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। অধিকন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত ও অনুমোদিত না হলে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারেন না। এভাবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ককে অসম করে তোলা হয়েছে। তাই রাষ্ট্রপতিকে অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর অধস্তন বলেই মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাহী ক্ষমতা অত্যধিক মাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত রয়েছে।

নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগের হাতে রয়েছে। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে বলে মনে করছে বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রে তিনটি অঙ্গ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারো ওপরে নয়। শ্রেষ্ঠত্ব বা সার্বভৌমত্বের মালিক বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশে আইন বিভাগ সার্বিক বিবেচনায় দুর্বল, অগোছাল ও অবিন্যস্ত। তাদের ভূমিকা ও কার্যক্রম নিয়ে আছে।

কখনো কখনো সংসদে সরকারি দলের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় নানা প্রশ্ন উঠছে এর কাজ নিয়ে। কিন্তু সংসদকে অস্বীকার করার উপায়ও নেই। কারণ এখনো যেটুকু গণতন্ত্র কার্যকর আছে তা এই সংসদের কারণেই। তবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যদি কোন প্রতিবন্ধকতা হয়ে থাকে তা নিয়েও বড় পরিসরে আলোচনা হতে পারে। অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ যেমন ইংল্যান্ড ও ভারতে এমন বিধান নেই। সেখানে সদস্যরা স্বাধীনভাবে বক্তব্য দিতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারেন।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ দ্রুততার সাথে। রাজনৈতিক সমঝোতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় সব সংকটই মোকাবিলা করা সম্ভব।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন