ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘উদ্দেশ্যমূলক না ভুল’

প্রকাশিত: ০৯:১২ এএম, ০১ জুন ২০১৫

গত ২৬ মে হাইকোর্টের একটি ছোট্ট রায়, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি বড় শিক্ষা হতে পারে। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ ভুল সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছেন। জরিমানার টাকাটা পাবেন হামিদা আক্তার নামে এক গার্মেন্টস শ্রমিক। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, প্রথম আলোতে ভুল সংবাদ প্রকাশ করায় এই শ্রমিক সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন। তাই তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যাক গার্মেন্টস শ্রমিক বলেই হয়তো, তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার ক্ষতির দাম মাত্র এক লাখ টাকা। টাকার অঙ্ক যাই হোক, বাংলাদেশে যে ভুল সংবাদ প্রকাশ বা প্রচারের মাধ্যমে কাউকে হেয় করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, এই বিশ্বাসের দাম অনেক বেশি।

যে নিউজ নিয়ে এতো আলোচনা, সেটি ছাপা হয়েছে গত ১০ মে প্রথম আলোর নবম পৃষ্ঠায়; শিরোনাম ‘ছুটি মেলেনি, কারখানার টয়লেটে সন্তান প্রসব’। চারদিকে উদ্দেশ্যমূলক নিউজ দেখতে দেখতে আমাদের স্বভাব এতোটাই খারাপ হয়েছে যে, এ সংবাদটি দেখেও আমার কু-মন নেতিটাই ভেবেছে। আসলে আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। নিউজে বলা হয়েছে, গাজীপুরে অ্যাপেক্স ফুটওয়ার কারখানায় এক অন্তঃস্বত্ত্বা নারী শ্রমিক ছুটি চেয়েও না পেয়ে কারখানার টয়লেটে সন্তান প্রসব করেছেন। নিউজটি পড়ে আমার এর সত্য-মিথ্যার চেয়ে প্রথম যে প্রশ্নটি মনে এসেছে, প্রথম আলোর সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর লাগলো কবে? কারণ বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এটাই বাস্তবতা। প্রথম আলোর সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর যে মধুর সম্পর্ক, তাতে সত্যি হলেও এ ধরনের নিউজ ছাপানোর কথা নয়। তার মানে কোনো ঘাপলা হয়েছে।

বাংলাদেশে কোনো পত্রিকায়, টিভিতে বা অনলাইনে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে-বিপক্ষে, ভালো-মন্দ নিউজ দেখলেই আমি বুঝি, এটা সংবাদমানের কারণে ছাপা হয়নি, হয়েছে সেই কোম্পানির সঙ্গে ওই গণমাধ্যমের সম্পর্কের ভিত্তিতে। প্রথম আলোও এই দোষে দুষ্ট। প্রথম আলোও ইচ্ছা করে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাগে। বিশেষ করে বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের কথা সবার জানা। কিন্তু প্রথম আলো সাধারণত ভুল নিউজ করে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো নিউজ করলেও, তাতে সাংবাদিকতার মান বজায় রাখার চেষ্টা করে। তাই এ নিউজটিকে আমি সত্য বলে ধরে নিয়ে, কেন এটি ছাপা হলো, তা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঘটনা তা নয়। প্রথম আলোর সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সম্পর্ক এখনো আগের মতোই চমৎকার। পরদিনই প্রথম আলো নিউজের সংশোধনী ছাপে। দু’দিন পর ১৩ মে নিউজটি ভুল ছিল বলে স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করে।

বিষয়টি আমার জন্য নানা কারণে স্বস্তির। প্রথমত প্রথম আলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে অ্যাপেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে লাগেনি, এটা ভাবতে পেরে ভালো লাগছে। তাছাড়া প্রথম আলো সংশোধনী ছেপেছে এবং ক্ষমাও চেয়েছে। শুনেছি, শুধু পত্রিকার পাতায় নয়, ব্যক্তিগতভাবেও প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। আমিও সবসময় চাই কোনো গণমাধ্যম ভুল কিছু করলে যেন তা স্বীকার করে এবং প্রয়োজনে ক্ষমা চায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা হয় না। নিজেদের বিশাল অপমান ভেবে পুরো বিষয়টি চেপে যান। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনো অপমান নেই, মহত্ত্ব আছে। ব্যাপারটি অ্যাপেক্সের বলেই প্রথম আলো সংশোধনী ছেপেছে এবং ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে। কিন্তু ঘটনাটি অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘটলেই উল্টো ব্যাপার হতে পারতো।

ভুল হতেই পারে। যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভুল করতেই পারে। অন্তত উদ্দেশ্যমূলকের চেয়ে ভুল স্বস্তিদায়ক। তবে প্রথম আলো নিজেদের দক্ষতার, বস্তুনিষ্ঠতার, প্রভাবের যে জায়গায় তুলে নিয়েছে, তাতে এ ধরনের ভুল করারও সুযোগ নেই তাদের। দক্ষ জনবল কম থাকলে, কাজের চাপ অনেক বেশি হলে, তাড়াহুড়ো থাকলে এ ধরনের ভুল হতে পারে। কিন্তু প্রথম আলো এখন বাণিজ্যিকভাবে যতোটা সফল, তাতে তারা চাইলেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লোক রাখতে পারে। যে কাজটা পাঁচজনে করতে পারে, সেখানে তারা আটজন লোক রাখতে পারে। ভুল করলে তা স্বীকার করাটা ভালো। তবে সে ভুলের সংখ্যা যেন কম হয়। ‘প্রথম আলো উদ্দেশ্যমূলক নিউজ করে, কিন্তু ভুল নিউজ করে না’ আমার এই ধারণাটা যে ধাক্কা খেল।

এই নিউজে আরেকটা বিষয় প্রমাণিত হলো, সংবাদপত্রের ক্ষমতা। নবম পৃষ্ঠায় এক কলামের একটি নিউজ, তাও ঢাকার বাইরে থেকে পাঠানো। কিন্তু সেই নিউজই রীতিমত তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। প্রথম আলোর এই নিউজের রেফারেন্স দিয়ে না-কি একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই নিউজটি ছেপেছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, শুনেছি, এই নিউজের প্রতিক্রিয়ায় না-কি অ্যাপেক্স গ্রুপের মোটা অঙ্কের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রফতানিখাত এখন আন্তর্জাতিকভাবে মারাত্মক প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে। সারাক্ষণ আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষরা ওঁৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই এর ধরনের নিউজের ক্লিপিং তুলে দেয় বায়ারদের টেবিলে। তাজরিন আর রানা প্লাজার পর আমাদের তৈরি পোশাক খাত যে ধাক্কা খেয়েছে, তা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। তাই অন্তত রফতানিমুখী শিল্প নিয়ে কোনো রিপোর্ট করার আগে পাঁচবার চেক করা আর দশবার চিন্তা করা উচিত। যেমন এই নিউজটি যদি সত্যিও হতো, তাহলে দেশের স্বার্থ বিবেচনায় এটি ছাপা উচিত হতো কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। আমি সবসময় গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আবার এও বিশ্বাস করি, সব সত্য সংবাদ নয়, আর সব সংবাদ প্রকাশযোগ্য নয়। এমনকি আমাদের সংবিধানেও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, তবে শর্তসাপেক্ষে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষ সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইলো।’ তাই নিউজটা ছোট, ভাবনাটা অনেক বড়, হাইকোর্টের রায়ের প্রভাব আরো বেশি।

হাইকোর্টের রায়ে আমি আরেকটা কারণে স্বস্তি পেয়েছি। এতোদিন নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে হতো। ইচ্ছা হলেই যেন সাংবাদিকরা যা খুশি তাই করতে পারে। তাদের বলার কেউ নেই। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেই আমরা বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে। এমনকি সেই সাংবাদিক অপরাধ করলেও। আবার উল্টোটাও আছে। এই কদিন আগেই প্রথম আলোরই এক সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের পর আমরা সবাই একটা স্বস্তি পাবো, যাক কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আবার মুহুর্তেই স্বস্তিটা হারিয়ে যায়। যখন ভাবি, পত্রিকাটি প্রথম আলো বলেই সেটি হাইকোর্টের নজরে এসেছে, তারা রুল দিয়েছেন, জরিমানা করেছেন। কিন্তু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রতিদিন কতো শত পত্রিকা, টিভি, অনলাইন; কতো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইচ্ছা করে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কতো নিউজ করছে; কতো অসহায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; তার কোনো হিসেবও আমরা জানি না। সেগুলো কোনোদিন হাইকোর্টের নজরেও আসবে না, হয়তো সেই ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, কোনো প্রতিকারই পাবেন না। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলছি, অনেক পত্রিকা প্রকাশই করা হয়, লোকজনকে সামাজিকভাবে হেয় করার ভয় দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য। টাকা না পেলে সংবাদ প্রকাশ করে হেয় করা হয়। এতোদিন এর কোনো প্রতিকার হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তরা প্রেস কাউন্সিলে গেলেও সেখানে কোনো প্রতিকার পান না। এবার সেই ক্ষতিগ্রস্তরা হাইকোর্টের এ রায়কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।

লাভ আছে সাংবাদিকদেরও। অনেক সময় দেশের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কাউকে হেয় করে কোনো সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে স্থানীয় প্রশাসন সেই পত্রিকাকে নানাভাবে হয়রানি করতো। এখন আর সে সুযোগ থাকবে না আশা করি। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হেয় করলে এবং তা প্রমাণিত হলে, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেবেন, প্রশাসনের এখানে নাক গলানোর সুযোগ থাকবে না। আশা করি হাইকোর্টের এই রায় থেকে আমরা সবাই আরো শিখবো, আরো সতর্ক হবো।

০১ জুন, ২০১৫



এইচআর/পিআর