ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধর্ষকের অভয়ারণ্য

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৩:৪৮ এএম, ১০ আগস্ট ২০১৭

অন্ধকার আর গাঢ় অন্ধকার। ক্রমশ তিমিরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে সমাজ। একের পর এক ধর্ষণের সংবাদ। রেহাই পাচ্ছে না চার বছরের শিশুও। বাড্ডায় চার বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই পৈশাচিক ঘটনায় স্তম্ভিত দেশ। কিন্তু তারপরও থেমে নেই ধর্ষণের খবর। বগুড়ায় ধর্ষণের শিকার তরুণী ও তার মাকে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনাও জনমনে আলোড়ন তুলেছে। ঢাকার বনশ্রীতে গৃহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে এলাকাবাসী। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিশোরীকে চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণের ঘটনা অতি সাম্প্রতিক। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে চলছে আরও বেশি নির্যাতন। প্রতিদিন এক বা একাধিক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

একজন নারী কোথাও নিরাপত্তা পাচ্ছে না। সৎ বাবা এমনকি আপন বাবার কাছেও নিরাপত্তা পাচ্ছে না কন্যা শিশু। আপন বাবার হাতেও ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ ছাপা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, নিজের ঘরে, হাসপাতালে, গণপরিবহনে কোথাও নিরাপত্তা নেই নারীর। পাঁচ সন্তানের জননী থেকে পাঁচ মাসের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী গত ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৬৮৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার (বিএমবিএস) মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের তথ্যমতে, ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫.১৭ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিএমবিএসের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুধু জুলাই মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮০ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ৩২ জন কন্যাশিশু।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ধর্ষকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। অমানুষরা বিকৃতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। নারীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদা এদেশের সিংহভাগ পুরুষের নেই। এ কথার প্রমাণ স্বরূপ আমি যে কোন নিউজ পোর্টালের নারী অধিকার বা এ ধরনের লেখার নিচে প্রকাশিত মন্তব্যগুলো পড়তে আহ্বান জানাই। কুৎসিত ভাষায় সেখানে নারীর উদ্দেশ্যে গালাগাল বর্ষিত হয়। যারা এসব কুৎসিত মন্তব্য করে তারা নিঃসন্দেহে ধর্ষকামী। এরা পোটেনশিয়াল ধর্ষক। সময় ও সুযোগ পেলে এরা যে কোন নারীকে ধর্ষণ করবে। রাস্তাঘাটে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি যারা করে, যারা ভিড়ের বাসে সুযোগ পেলে নারীকে অশালীনভাবে ধাক্কা দেয়, যারা পথচলতি বা রিকশাযাত্রীর নারীর উদ্দেশ্যে নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় তারা সবাই পোটেনশিয়াল ধর্ষক।

কিন্তু কেন এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না এই জঘন্য অপরাধ? এই অপরাধ বন্ধ করতে একদিকে দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ, অন্যদিকে দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। দু’চারজন ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলানো দরকার সবার আগে। দৃষ্টান্তমূলক কয়েকটি শাস্তির ঘটনা ঘটলেই অন্য সম্ভাব্য অপরাধীরা ভয় পাবে। দ্রুত বিচারের আওতায় ধর্ষণের বিচার হওয়া দরকার।

আর সবচেয়ে বেশি দরকার গণমাধ্যমে এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার সহিংসতারোধে সমাজে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীকে যৌন সামগ্রী ভাবার অসুস্থ মানসিকতা দূর করতে হবে সমাজ থেকে। ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌনহয়রানিকে অনেক পুরুষই বড় কোন অপরাধ বলে মনে করে না। ভাবখানা হলো, ইচ্ছা করলেই একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা যায়। এতে আর এমন কি ক্ষতি হয়! এদের কাছে ধর্ষণ একটি বিকৃত বিনোদন মাত্র। এটি যে গুরুতর অপরাধ এবং এর শাস্তি যে কঠোর সে কথাটি প্রচার করতে হবে সমাজের সর্ব স্তরে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষায় হয়রানি, প্রভাবশালীদের হুমকি, ধর্ষককে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এসব কারণে অপরাধীদের ধারণা হয় ধর্ষণ করে পার পাওয়া যাবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এর জন্য দায়ী। সরকারকে জিরো টলারেন্স মনোভাব নিয়ে প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সেবামূলক সংস্থাকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি সদা সর্বদা ধর্ষিত হওয়ার আতংক নিয়ে বেঁচে থাকে তাহলে কিভাবে তারা উন্নয়নের অংশীদার হবে? একেবারে শৈশব থেকে পুরুষকে ধর্ষণবিরোধী করে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিতে হবে। এই সমাজে এখন কোন নারী নিরাপদ নয়, কোথাও নিরাপদ নয়। পাহাড়ে, সমতলে, ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে, হাসপাতালে, ঘরে, পথে সর্বত্র ধর্ষকের উল্লাস ধ্বনি। এই ধর্ষকের অভয়ারণ্য আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমি হতে পারে না। দেশকে ধর্ষণমুক্ত করা এখন এক নম্বর জাতীয় কর্তব্য।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন