বিলুপ্তির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় বেশকিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই তারা এ দেশে বসবাস করছেন। এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে তারা আমাদের সংস্কৃতিকে করছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও পরিপুষ্ট। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা যেন নিজ ভূমে পরবাসী। সাংবিধানিকভাবে এসব জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি তাই কোনোভাবেই উপেক্ষার নয়।
প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীরই রয়েছে দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা। কোনো কোনো নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষার লিপি বা বর্ণমালা। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো বলয়ে বিলীন এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্যানুযায়ী স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতিজনিত অনবরত স্থানান্তর ক্রমশ তাদের বিচ্ছিন্ন ও লঘু নৃ-গোষ্ঠীরূপে পরিণত করেছে। সংখ্যালঘুতার কারণে প্রতারিত ও বঞ্চিত জীবনের ভার বইতে বইতে গুটিয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে। কখনো বা বিসর্জন দিয়েছে আত্মপরিচয়, নাম, গোত্র এমনকি ধর্মবিশ্বাস পর্যন্ত।
অধিকারবঞ্চিত এসব নৃ-গোষ্ঠীর অনেকে বর্ণহীন বলেই তাদের জীবনের সুমহান বাণী লিপিবদ্ধ হয়নি মাতৃভাষায়। তাইতো তারা আজ বিলুপ্তির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। কিন্তু লিখিত বর্ণমালা না থাকা সত্ত্বেও নিসর্গকেন্দ্রিক জীবনে তাদের উৎসব, পার্বণ, নৃত্য, গীতিনাট্য, গীতিকা, পালা ইত্যাদি শিল্প এবং নানারকম ক্রীড়া কসরৎ ইত্যাদি গড়ে ওঠে জুমকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ঘন-গম্ভীর শালবনের পাতায় পাতায় ঠোঁটের স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে শিশু-রোদের কণা ছড়িয়ে পড়ত জুমচাষে নিরতা গারো রমণীর বাদামি অথবা শ্যামলা কালো গ্রীবার পরে। শ্রমক্লান্ত স্বেদসিক্ত, প্রাকৃত সুন্দরী তার ছোট ছোট চোখে সেই সদাহাস্য রৌদ্রকণার দিকে তাকিয়ে সংযুক্ত দুই কর কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানাত তার ফসলের দেবতা 'সালজংকে'।
প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে এরকম নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিপুল সম্ভার। বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে উল্লেযোগ্য ও আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দুঃখজনক হচ্ছে, নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সামগ্রিক রূপটি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের নিকট অনেকটাই অপরিচিত রয়ে গেছে। এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠীর জনসাধারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন। এর পেছনেও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সুদূর অতীতকালে তারা যখন এতদাঞ্চলে অভিবাসন শুরু করে, তখন পূর্ব-বাসস্থলের ভৌগোলিক আবহের সঙ্গে যে অঞ্চলের মিল পেয়েছে সেখানেই তৈরি করেছে আবাসন। অর্থাৎ পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাস গড়ে তোলে। এর ফলে ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে এদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এভাবে মূল জনস্রোতের জীবন, সংস্কৃতি ও ভাষা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ক্রমশ তাদের দূরত্ব স্থায়ী হয়।
এ ছাড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনে নৃ-গোষ্ঠীর নরনারী ও তাদের সংস্কৃতি ক্রমশ বৃহত্তর জনজীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাছাড়া বাঙালিদের সঙ্গে নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক প্রথা, রীতিনীতি, ধর্মীয় কৃত্যাদি, আচার-অনুষ্ঠান, খাদ্য, সাংস্কৃতিক ও কৃষিপদ্ধতির কারণেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ভৌগোলিক পরিমণ্ডল অভিন্ন না হওয়ায় এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য সূচিত হয়। তাই বাংলাদেশের এক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। নৃ-গোষ্ঠীগুলোর প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষারীতি কালের স্রোতে বাহিত হয়ে চলেছে তাদের সমাজে। নিজেদের গুটিয়ে রাখতে, তাদের আচরিত জীবনযাপন পদ্ধতি ও ভাষারীতি যতটা সম্ভব আঁকড়ে থাকতে তারা সদা তৎপর।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে ভৌগোলিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আর এই দূরত্বই সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোতধারা থেকে করেছে বিচ্যুত। অথচ এদের ঔজ্জ্বল্যটুকু ধরে রাখতে পারলে, সর্বসাধারণ্যে তুলে ধরতে পারলে শুধু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীই নয়; সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে সবাই। এজন্যই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সারল্যে ভরা জীবনাচারের অধিকারী ক্ষুদ্র এসব নৃ-গোষ্ঠী সম্পর্কে সবাইকে কৌতূহলী করে তোলা একান্ত অপরিহার্য। এসব কারণেই তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে গৌণ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আদিবাসীরা কি ক্ষুদ্র বা লঘু নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত হবে। আদিবাসী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরা এ বিষয়ে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন। চাকমা সার্কেলের প্রধান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী দেবাশীষ রায় ওয়াংঝা তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, 'সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়া হলে তাদের জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয়তা রেখে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আদিবাসীরা সম্পৃক্ত হতে পারবে। আদিবাসীদের স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠী যে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে, তা বিশ্বাস করা অবাস্তব। যথাযথ স্বীকৃতি পেলে আদিবাসীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিবারের পূর্ণ সদস্যপদ পাবে মাত্র এবং একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা সূচক রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি, সনদ ও প্রতিবেদনে স্বীকৃত। এরমধ্যে হলো- ১. তাদের প্রান্তিক অবস্থান, ২. প্রথাগত আইন অনুসরণ করে সনাতনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ৩. প্রাচীন আবাসভূমির সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ও আত্মিক সম্পর্ক থাকা এবং ৪. নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি থাকা।'
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার করেছিল। ইশতেহারে বলা হয়, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা আদিবাসী বা জাতিগত সংখ্যালঘুর ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান করা হবে। তাদের সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে।’ কাজেই তাদের উচিত হবে জনরায়ের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি শুধু এসব জনগোষ্ঠীর স্বার্থেই নয়; বরং দেশের বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায়ও এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আদিবাসী বলি আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, যাই বলা হোক না কেন, তারা এ দেশেরই নাগরিক। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তাদেরও এই দেশের জল-হাওয়া সমানভাবে স্পর্শ করে। এসব নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি। রয়েছে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানও।
সংখ্যা বা জাতিসত্তার বিচারে নয়; এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তাদেরও এই রাষ্ট্রের সবকিছুতে সমান অধিকার রয়েছে। সেটা নিশ্চিত করাই হোক এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/আরআইপি