বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো জোট
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। নতুন দল গড়ছে, দল ভাঙছে, নতুন জোট গড়ছে, জোট ভাঙছে, পুনর্গঠিত হচ্ছে। নির্বাচনের আগে জোটের রাজনীতির এই প্রবণতা এ অঞ্চলের অনেক পুরোনো। ৫৪ সালের নির্বাচনে সরকার বিরোধী শক্তিগুলো অংশ নিয়েছিল ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে। তারপর সময়ে সময়ে আন্দোলনে-নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো নানা নামে জোট গড়েছে। কোনো জোট আন্দোলনের, কোনো জোট নির্বাচনের, কোনো জোট আদর্শিক, কোনো জোট কৌশলগত। এখন বাংলাদেশে অনেকগুলো জোট আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট, ১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টি মিলে মহাজোট, বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ৫৯ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোট, সিপিবি-বাসদ মিলে বাম জোট ছাড়াও নানান খুচরা জোট আছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে আরো নানান জোট হচ্ছে, হবে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে সম্প্রতি আরো একটি জোট গঠনের পাঁয়তারা চলছে। সাম্প্রতিক দুটি বৈঠককে ঘিরে চলছে নানা আলোচনা-গুঞ্জন। ১৩ জুলাই আ স ম আব্দুর রব এবং ২ আগস্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমন দল ছিল ৫টি- বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। প্রথম বৈঠকে থাকলেও বাসদ (খালেকুজ্জামান), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং অরাজনৈতিক সংগঠন ‘সুজন’এর প্রতিনিধিরা দ্বিতীয় বৈঠকে ছিলেন না। তবে দ্বিতীয় বৈঠকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপস্থিতি চমক সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় বৈঠকে জোট গঠনের লক্ষ্যে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে প্রধান করে একটি লিয়াজো কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি বৈঠকেই এই সম্ভাব্য এই জোটকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ হানা দিলেও আ স ম আব্দুর রবের উত্তরার বাসায় প্রথম বৈঠকটি হয়েছে শেষ পর্যন্ত। তবে বি চৌধুরীর বারিধারার বাসার বৈঠকটি হয়েছে নির্বিঘ্নেই।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তির সমাবেশ ঘটাতেই এই জোট গঠনের উদ্যোগ, এমনটা বলা হলেও বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, এই দুই দলের বাইরে অন্য কারো তেমন জনসমর্থন নেই। তাই দল হোক, আর জোট হোক তাদের এদিকে বা ওদিকে- একদিকে ঝুকতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো সম্ভাব্য নতুন এই জোট কোন দিকে যাবে? দুই পক্ষই তাদের কাছে টানতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। মির্জা ফখরুল এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। আশা করছেন, তারা সরকারের অন্যায়, দুর্নীতি, অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাদের স্বাগত জানিয়েছেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, ‘গণতন্ত্রের শত ফুল ফুটছে, ভালো তো। এটাই গণতন্ত্রের বিউটি। জোট হবে, গ্রুপ হবে। এটা হতে থাক, অসুবিধা কি?
নির্বাচনকে সামনে রেখে যা হচ্ছে তা ভালো দিক। তবে শেষ পর্যন্ত এ মেরুকরণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।’ ওবায়দুল কাদের অপেক্ষায় থাকার কথা বললেও এরশাদ অবশ্য হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। বি চৌধুরীর বাসায় জি এম কাদেরের উপস্থিতি যে রহস্যময়তা তৈরি করেছিল, এরশাদ তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী সম্পর্কে আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেছেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেবকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইফতারের দাওয়াত করেছিলেন। তার অর্থ তিনি সরকারের বিরুদ্ধে নন; না হলে আর কাউকে তো তিনি আমন্ত্রণ করেননি। সেই অনুষ্ঠানে তিনি আমার পাশে বসেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে প্রতীয়মান হয় তিনি মিত্রবাহিনীতে আছেন।’ মিত্রবাহিনীর বি চৌধুরীর নেতৃত্বে যে জোট হচ্ছে, তা কোনদিকে হেলে থাকবে? যে পাঁচটি দল মিলে জোট করার উদ্যোগ নিয়েছে সবগুলোই ‘বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো’ টাইপ। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গঠিত হয়েছে গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আর নাগরিক ঐক্য। আর বি চৌধুরী বিকল্পধারা গড়েছেন বঙ্গভবন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর। আর আ স ম আব্দুর রবও অনেক ঘাটের জল খাওয়া। এখনও জেএসডি নামে সংগঠন করলেও জাসদের আদর্শের সাথে দূরতম সম্পর্ক নেই জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রবের।
প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রবের অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবশ্য একটা রেকর্ড আছে। ৮৮ সালের নির্বাচনে ৭২ দল মিলে সম্মিলিত বিরোধী দল করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বিরোধী দলীয় নেতাও হয়েছিলেন। অবশ্য সবাই তাকে গৃহপালিত বিরোধী দলীয় বলতো। রওশন এরশাদ বাংলাদেশের প্রথম গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা নন। আ স ম রব পরে আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারেরও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই পাঁচ দলের আদর্শিক অবস্থান কখনোই পরিস্কার নয়। তাদের দল ভাঙাগড়া আদর্শিক কারণে হয়নি। হয়েছে ব্যক্তিগত পদ-পদবী, লাভালাভের হিসেবে।
বিএনপি বের করে না দিলে তো বি চৌধুরী বঙ্গভবনেই থাকতেন। প্রথম কিছুদিন কট্টর বিএনপি বিরোধিতা করলেও পরে আবার বিএনপির কাছাকাছি হয়েছিলেন বি চৌধুরী। কখন তিনি ‘মিত্রবাহিনী’তে যোগ দিলেন, তা অবশ্য আমরা জানি না, এরশাদ গোমর ফাঁক করে না দিলে জানতামও না। ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লগের মনোনয়নে এমপি থেকে রাষ্ট্রপতি সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, কোনো নির্বাচনেই পাশ করতে পারেননি। তার আওয়ামী লীগ বা কাদের সিদ্দিকীর আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাওয়ার সাথে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই। নিছকই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ।
ডাকসুর দুবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ-বাসদ হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি কট্টর আওয়ামী সমালোচক। আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ায় নিজেই নিজেকে ‘বেকুব’ বলেছেন। এই স্বঘোষিত ‘বেকুব’ মাহমুদুর রহমান মান্নাই নতুন জোটের সমন্বয়কারী। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আদর্শহীন সুবিধাবাদী জোট শেষ পর্যন্ত কোনদিকে যায়, তা জানার জন্য ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়- ‘তবে শেষ পর্যন্ত এ মেরুকরণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।’
৭ আগস্ট, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/আরআইপি