রাজনৈতিক ক্ষমতা ও তুফানের ধর্ষণ
ধর্ষণের সঙ্গে সম্ভবত ক্ষমতার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তার কারণ, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তার দলীয়, উপদলীয়, শাখা, শাখার শাখা সংগঠনের পুরুষদের ধর্ষণের প্রবণতা ও মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আরো আরো আরো বিভিন্ন শাখা লীগের অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন সময়ের ধর্ষণের মোট হিসেব অন্য যে কোন সময়ের ধর্ষণের রেকর্ডকে অতিক্রম করবে। এই বাস্তবতা কেবল আওয়ামী লীগের জন্যই সত্য, এমন ভাববার কারণ নেই কোনও।
বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন আবার যুবদল, ছাত্রদল, আরো আরো আরো যত প্রকার বিএনপি সমর্থিত দল বা দলের শাখা সংগঠন রয়েছে তাদের দলীয় পুরুষেরা দলে দলে ধর্ষণে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। মনে আছে নিশ্চয়ই, বিএনপি যখন ক্ষমতায়, ঢাবির মেয়েদের হলে যুবদলের ছেলেরা অতর্কিত প্রবেশ করে নির্বিচারে যৌন হয়রানি করেছিল। ছাত্রদলের ছেলেরা কারো ছিনিয়ে নিয়েছিল ওড়না, কাউকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করেছিল। আবার জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের জসিম উদ্দিন মানিক যখন একের পর এক ধর্ষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ধর্ষণের শততম সেঞ্চুরি পালন করেছিল, আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়।
আমি কখনই ধর্ষণকে রাজনৈতিকভাবে দেখতে চাই না। আওয়ামী লীগের ধর্ষক মন্দ, বিএনপি’র ধর্ষক ভালো, এমন তো নয়। ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসেবেই দেখতে চাই। অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই। ধর্ষণ তো একটি রাজনৈতিক দলের সবাই করে না, করে কেউ কেউ। যে ধর্ষক সে আওয়ামী লীগে থাকলেও ধর্ষণ করতো, বিএনপিতে থাকলেও ধর্ষণ করতো, জাতীয় পার্টিতে থাকলেও ধর্ষণ করতো বা কোন দলে না থাকলেও ধর্ষণ করতো; যদি তার মনোজগতে ধর্ষণের আকাঙ্খা থেকে থাকে। তবে এটাও সত্য, ধর্ষকেরা যখন কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, সে তখন তার রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাকে ধর্ষণের স্বার্থে অপব্যবহার করে। দলীয়করণে চারপাশ উপচে পড়ছে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই সে দেখে তার লোক। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে, দলীয় বলয় তাকে এক ধরনের সহযোগিতা করে, সুবিধা দেয়। সে তখন ভাবে, তার ধর্ষণকে দল ও দলীয় মানুষেরা আস্কারা দেবে, করতে কোন অসুবিধে নেই। তখন ঘটনাটি ঘটায়। ঠাণ্ডা মাথায়, নিশ্চিন্তে, আনন্দে ধর্ষণটি করে সে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত সামাজিক কর্মকাণ্ড, পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না। বাংলাদেশে এককভাবে ধর্ষণ করা হয়, এবং দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়; এবং ধর্ষণের পর ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে, জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়িকে, সহপাঠী ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের মেথরানিকে, গৃহশিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, ইমাম ধর্ষণ করে আমপারা পড়তে আসা কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধূকে, দেবর ধর্ষণ কর ভাবীকে; এবং দেশজুড়ে চলছে অসংখ্য অসম্পর্কিত ধর্ষণ। চলছে দলবদ্ধ ধর্ষণ;- রাতে গ্রাম ঘেরাও করে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে গৃহবধূদের (কয়েক বছর আগে ঠাকুরগাঁয়ে ঘটে এ ঘটনা); নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে হত্যা একটি বালিকাকে; (১৯৯৫ এর আগস্ট মাসে দিনাজপুরে)। মহাবিদ্যালয়ে প্রেমিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্ররা দলগতভাবে ধর্ষণ করে ছাত্রীকে (ব্রজমোহন কলেজ, ১৯৯৫); মাস্তানরা বাসায় ঢুকে পিতামাতার চোখের সামনে দলগতভাবে ধর্ষণ করে কন্যাদের (বিভিন্ন শহর ও গ্রামে)। বাংলাদেশ আজ ধর্ষণকারীদের দ্বারা অবরুদ্ধ। বাংলাদেশে নারী বাস করছে নিরন্তর ধর্ষণভীতির মধ্যে। চাষীর মেয়ে মাঠে যাবে- সে আর কোনো ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; মেয়েটি স্কুলে বা মহাবিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে- সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; মেয়েটি বাইরে যাবে- সে আর কোনো ভয় পাচ্ছে না, কিন্তু ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। এভাবেই বাংলাদেশের ধর্ষণ পরিস্থিতির বর্ণনা করেছিলেন, ড. হুমায়ন আজাদ।
এত কথা, এত লেখা, এত টকশো, এত সেমিনার, ধর্ষণ কিন্তু কমছে না। ধর্ষণ কমবেও না, যদি না চাই আমরা। একটি ধর্ষক সমাজ গড়ে তুলে সারাদিন যদি চিৎকার করি, ‘ধর্ষণ বন্ধ হোক, ধর্ষণ বন্ধ হোক’,- লাভ হবে না। নারীর প্রতি সম্মান নেই। নারী কেবলই ভোগ্য বস্তু, যৌনযন্ত্র। নারীকে যোনি সর্বস্ব, যৌনবস্তু ভাবার প্রবণতা যতদিন না বন্ধ হবে, ধর্ষণ নির্দ্ধিধায়, নির্বিচারে, আরামসে বসবাস করবে সমাজে। নারী বোরকা পড়লে যৌনবস্তু, উদোম থাকলেও যৌনবস্তু- এইতো ধারণা আমাদের। ফলে সে একটি কেন, একশটি বোরকা পড়লেও তার প্রতি ধারণা ও মানসিকতা আমাদের একই। ফলে সে শত পর্দা, সহস্র পর্দায় থাকলেও অনিরাপদ।
ধর্ষিতাকে কেবল ধর্ষণ করেই আমাদের সুখ হয় না। তাকে ‘পতিতা’ আখ্যা না দিতে পারলে, খারাপ মেয়ে, মন্দ মেয়ে, নষ্ট মেয়ে, বেশ্যা বলতে না পারলে পুরোপুরি সুখ হয় না। তাই যখনই, সেখানেই, যে মেয়েই ধর্ষণের শিকার হোক, ধর্ষণ পরবর্তী ঘটনায় আমাদের বেশির ভাগের মন্তব্যই ‘মেয়েটা খারাপ ছিল, ‘লাইনের ছিল’, ‘আরে নষ্ট ছিল’। অত্যাচারিতের সম্পর্কে যখন এমন মন্তব্য ও মানসিকতা সমাজের, তখন অত্যাচারিতো পার পাবেই। তার মানে অন্যায়ের, অপরাধের ও অপরাধীর প্রতি আমাদের এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক সমর্থন ভেতরে ভেতরে রয়েছে।
আমরা কেবল এক তুফানকে জানি, ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে বলে। এমন তুফান, আরও অসংখ্য রয়েছে সমাজে নিশ্চিত। তুফানরা তো একদিনে তুফান হয়ে উঠেনি। একদিনে কেউ তুফান হয়ে উঠে না, উঠতে পারে না। বিকৃতকাম এসব সাইকোপ্যাথ মানুষদের ‘প্যাথলজিক্যাল সাপ্লাই’ দিতে হয়। তুফানকে এতদিন ‘প্যাথলজিক্যাল সাপ্লাই’ দিয়ে এসেছে তার দলীয় রাজনীতি, অবৈধ অর্থ ও অস্ত্র, এমনকি বিকারগ্রস্থ অনুশাসনহীন পারিবারিক আবহ। অন্যায় তো অন্যায়ই, অন্যায়কারীতো অন্যায়কারীই। অন্যায় জেনে, অপরাধ জেনেও আমরা যারা গোপন রাখি সেটাও এক ধরনের সমর্থন। ফলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এই সকল আরো আরো আরো তুফানদের আমরা যারা আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা, অর্থের জোগানাদাতা, সমর্থক তারা প্রত্যেকেই ধর্ষণকারী।
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে এখন সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী ছদ্মবেশী আওয়ামী সমর্থকে দেশ ভরে গেছে। নৌকায় এখন অমানুষ, জানোয়ার, দাতাল শুয়োরের অভাব নেই। বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে নিজেদের দাবি করছে প্রত্যেকেই। দেয়ালজুড়ে রাজনৈতিক পোস্টারের ছড়াছড়ি, সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছোট, চাঁদাবাজ, মাস্তান, সন্ত্রাসী এসব ‘তথাকথিত’ রাজনৈতিক নেতাদের ছবি বড়, যাদের অপকর্মে নৌকা ভারী হয়ে উঠেছে। ম্লান হতে বসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এতশত উন্নয়ন। এখনই শুদ্ধি অভিযানের সময়। শেয়াল, শুকরদের ঝেটিয়ে বিদেয় করতে হবে এখনই, নয়তো এদের কারণে দলকেও খেতে হবে নাকানিচুবানি।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর