ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কালো রাতের কালো অধ্যায়

আরিফা রহমান রুমা | প্রকাশিত: ০৪:১৩ এএম, ০১ আগস্ট ২০১৭

একটি রাত ফুরোতে লেগে গিয়েছিলো একুশটি বছর। সে রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু, তাঁর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবত এবং ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছিল সেসব ট্যাংক দিয়ে। পেছন ফিরে তাকালেই দেখি, ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বাড়ির চারপাশ থেকে গুলি শুরু হয়, একটি বুলেট এসে লাগে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই নাসেরের হাতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের সেই কালো রাতের মতোই আতঙ্কগ্রস্ত সবাই এসে জাতির পিতার শোবার ঘরে আশ্রয় নেন। বেগম মুজিব শাড়ির আচল ছিঁড়ে দেবরের বুলেট বিদ্ধ হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। ভাবীর হাতে দেবরের সর্বশেষ স্নেহের পরশ।

শেখ কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে গার্ডদের ব্যবস্থা নেবার কথা বলতে না বলতেই মেজর হুদার সঙ্গে থাকা একজন শেখ কামালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ‘দেখি তারা কী চায়” বলে বেরিয়ে আসেন পিতা, হুদার মুখোমুখি হয়ে কথা বলা সময়কালীন পেছন দিক দিয়ে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন তার স্বয়ংক্রিয় বন্দুক দিয়ে পিতার পিঠ গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। গুলিতে ঝাঁজরা হয় বাংলাদেশের প্রাণ, সিঁড়িতে লুটিয়ে পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। হিংস্র পৈশাচিকতায় মেতে ওঠে খুনির দল, মানুষের খোলসে লুকিয়ে থাকা হায়েনা ইতিহাসের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। একে একে হত্যা করা হয় বেগম মুজিব, শেখ জামাল, সুলতানা কামাল, রোজি জামাল আর শেখ নাসেরকে।

এদিকে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা ব্রিগেডিয়ার জামিলকে হত্যা করা হয় সোবহানবাগে। নরপিশাচ ফারুক, ডালিমদের পশুত্ব তখন পৃথিবীর সমস্ত পশুত্বকে হার মানিয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত দশ বছরের ছোট্ট রাসেলকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেবার নাম করে প্রথমে এক হাতে গুলি করা হয়, প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে ওঠা শিশুটি জীবন ভিক্ষার আবেদন জানায়, প্রত্যুত্তরে চিরদিনের মতো তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়। গোটা বাড়ি হয়ে ওঠে এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী।

সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসির দায়িত্ব পড়েছিল নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহত ১৮ মৃতদেহ দাফন করার। এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বর্ণনায় ‘কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ, হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি ঘরের দেয়ালে, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়াল গুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র।

প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেড রুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজি জামাল, নিচ তলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবীর ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল ছোট্ট শিশু রাসেলের লাশ।’

পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি, নাতি সুকান্তবাবু। প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, এবং আব্দুল নাঈম খান রিন্তুসহ কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন নিকটতম সদস্য ও বন্ধু। অমাবস্যার রাত থেকেও অন্ধকার ছিল সে রাত, এরপর অনেককাল এদেশের আকাশে আর সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘটনার শেষ আসলে এখানে নয় বলা যেতে পারে এটি ঘটনার শুরু।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয় ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র মতো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুটি ভিত্তি স্তম্ভ। গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তম্ভ হারিয়ে রাষ্ট্রের শুরু হয় উল্টো পথযাত্রা। যে শ্রেণি বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল চিন্তাধারা বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিলো এই হত্যাকাণ্ড ছিল সেই চলার পথে আকস্মিক, প্রচণ্ড এক কুঠারাঘাত। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত আর বিশৃঙ্খল দেশটির আর্থ-সামাজিক পুনর্বিন্যাসের শুরু হয়েছে কেবল। নতুন দেশ আর নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর কর্মী বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ড তাই প্রমাণ করে এটি কেবল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে হত্যার জন্য নয় এর পেছনে লুকিয়ে ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ফিরে যাবার এক সুগভীর চক্রান্ত।

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। পরবর্তী সময় ইতিহাসের আরেক খল নায়ক জিয়াউর রহমান এসে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে। এই অধ্যাদেশের দুটি অংশের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবেনা আর দ্বিতীয় অংশে আছে রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাঁদের দায়মুক্তি দেয়া হল অর্থাৎ তাঁদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন রকম আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবেনা।বাতিল করা হয় দালাল আইন, সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে, নাগরিকত্ব ফিরে পায় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম আর ডুকরে কেঁদে ওঠে ত্রিশ লক্ষ্য শহীদের আত্মা।

বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি ছিলেন, মানুষকে নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসতে পারার এক বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। ভালবাসার মানুষদের তাই বিশ্বাসও করতেন অকপটে। মানুষের খোলস আটা খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর বা মাহবুবুল আলম চাষীকে চিনতেও ভুল করেছেন। সাদাসিদে মধ্যবিত্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত তাঁর বাড়িটাও ছিল ততোধিক সাধারণ।খুনিদের আক্রমণ করতে এতোটুকু বেগ পেতে হয়নি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এ পর্যন্ত অধিকাংশ সময়কাল ক্ষমতায় থেকেছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনো তাই আমাদের আকাশে বাতাসে।পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, ৭৫ এর নারকীয় হত্যাকাণ্ড অথবা সাম্প্রতিক কালের জঙ্গি হামলা সবই একই সুতায় গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী একটি মানবিক বাংলাদেশ পেতে এই সুতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার কোন বিকল্প নেই। ১৫ই আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে আসুক তরুণ প্রজন্ম, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ শোকাবহ আগস্টে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন