যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না, সে হয়ে ওঠে নারীবাদী
কিছুদিন আগে এক ভারতীয় নারী বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আমি কি পুরুষকে ভয় পাই?’ ইদানিং আবার সেই প্রশ্নই নতুন হয়ে আমার কাছে এসেছে, ‘আমি কি পুরুষের প্রিয় হতে চাইছি?’ প্রথমেই বলবো, যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে চায় না, পারে না অথবা পুরুষের পেছনে লেগে থাকে সে হয় নারীবাদী, নয় হিজড়া। অবশ্য অঘোষিত সমকামী হবার সম্ভাবনাও থাকে। আমি এসবের কোনোটাই নই, হতেও চাই না। আমার কাছে ‘আঙ্গুর ফল টক’ নয়। আমার জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না এইসব মেয়েরা। মুখের উপর অপ্রিয় সত্য বলবার সাহসিকতার কারণে পরিবারের সব পুরুষই আমাকে নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতেন। তবে আমি আজকের মেয়েদের মতো অমন নির্বোধ, উগ্রবাদী সাহসিকতায় বিশ্বাসী নই, কোনোদিন ছিলাম না।
আমি সত্য সেখানেই বলবো যেখানে তার মূল্য আছে, যাদের সে সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা না থাকলেও সে সত্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীতে যতো মানুষ ততো মতাদর্শ। এই মহান সত্যকে আমি কেবল মর্মে উপলব্ধি করি না, সম্মান করি, অন্তরে ধারণ করি। কিন্তু সেই হাজারো মতাদর্শের ভিত্তিমূলেই আছে একটিমাত্র সত্য। তাই কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘ফ্যাক্টস আর মেনি, বাট ট্রুথ ইজ অনলি ওয়ান!’ একসময় সমগ্র নারীজাতির বসবাস ছিল অন্ধকারের মধ্যে। দিনের আলো দেখার সুযোগ পর্যন্ত সেদিন তাদের ছিল না। সেই নিয়ম পুরুষই তৈরি করেছিল, সঙ্গে ছিল অজ্ঞানতা, ধর্মান্ধতার ভিত্তিকে আঁকড়ে নির্মিত পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু তারও বিশ্লেষণ আছে।
সেদিন মানবসভ্যতা ক্রমাগত হামাগুড়ি দেয়া থেকে দাঁড়িয়ে সবেমাত্র গুটি গুটি পায়ে চলতে শুরু করেছিল। এমতাবস্থায় একমাত্র সবলরাই সমাজবিধি গড়ে তোলার দায়িত্ব নেয়াটাই স্বাভাবিক। আর কারা এই সবলেরা? নারীতো আজও নিজেকে অবলা বলে দাবি করতেই স্বস্তি পায়। তাহলে স্বাভাবিকভাবে সে দায়িত্ব নিশ্চয়ই পুরুষই নেবে। আর নিজের সুবিধাতো মানুষ আগে দেখবেই। সে নারী হলেও একই হতো (উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথাও সমাজব্যবস্থা’)। পুরুষ ও তাই করলো, ধীরে ধীরে গড়ে তুললো পুরুষশাসিত সমাজ (‘মাতৃতান্ত্রিক পারিবারিক প্রথা ও সমাজব্যবস্থা’ ভেঙে)। নারীকে করলো বন্দি। কিন্তু আবার সভ্যতার ছোঁয়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষা আর জ্ঞানের প্রভাবে সেই নিয়ম ভেঙে নারীকে সে অন্ধকার থেকে বের করে এনে যে আলো দেখালো, সেও কিন্তু সেই পুরুষই। সেদিনের সেই পুরুষের এতটুকু অবদান ছাড়া আমি বা আজকের প্রতিটি নারী কে হতো, কি হতো অথবা অন্যকেউ, অন্যকিছু হতো কিনা সে আলোচনা অবান্তর।
আমি শুধু বিশ্বাস করি আজ আমি যা হয়েছি, তার পেছনে আজকের এই যুগের কোনো নির্দিষ্ট পুরুষের পুরোপুরি অবদান হয়তো নেই। কিন্তু আমার আজকের এই স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি আর স্থিতির পেছনে রয়েছে সেদিনের সেই একদল মহাপুরুষের নির্বিকার নিষ্ঠা, ত্যাগ, মায়া, মমতায় জড়ানো প্রতিটি নারীর মর্যাদার প্রতি গভীর এক শ্রদ্ধাবোধ। আর এমন পুরুষ আজও দুর্লভ নয়। অনেক পুরুষই নারী উন্নয়নে এখনো শক্তিশালী ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন। সেদিনের এবং আজকের এই প্রতিটি পুরুষের সম্মানার্থেই পুরুষকে যে নারী ছোট করে, তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। আধুনিক মেয়েরা যেসব ছুঁচো পুরুষের কলঙ্কিত সস্তাদর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে ‘পুরুষ’ শব্দটার গভীরের ‘পৌরষ’কে স্থূলতার পথে চালিত করতে চায় সেটা কেবল তাদের অন্যায়ই নয়, সেটা মেয়েদের অকৃতজ্ঞতারই প্রকাশ।
নিজে নারী বলেই নারীজাতির এই অধঃপতনকে আমি মেনে নিতে পারি না। আমি পুরুষকে ভয় পাই কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলি যে, সত্যিকার অর্থে পুরুষকে যদি আমার ভয় পেতেই হয় তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। পুরুষতো আর বাঘ নয় যে আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমি পুরুষকে সম্মান করি, তাদের আমি শুধু পুরুষ নয়, মানুষ ভাবি। আমি আগেও বলেছি, যা আমার একান্ত অনুভূতি তা আমি বারবার বলবো। অল্পবয়সে একসময় আমিও নারীবাদী ছিলাম। কিন্তু জীবনের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, রুচিবোধ, রবীন্দ্রনাথ এইসব আমাকে উচ্চতর চিন্তার জগতে পৌঁছে দিয়েছে। যে নারী বয়সের সঙ্গে নারী-পুরুষ বিভেদীকরণের ধ্যান থেকে মুক্ত হয়নি, সে নারী বিকশিত হয়নি, সময়ের সঙ্গে তার আত্মোপলব্ধি হয়নি। পুরুষকে আমি এখন আর আমার সমকক্ষ ভাবি না। আমি মনে করি তার অবস্থান আমার অবস্থানের চাইতে ভিন্ন। কোথাও সে মহান, আমার চাইতে অনেক বড়, আবার কোথাও আমি তাকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে। চাইলেই আমরা একে অন্যের স্থানে আসতে পারবো না।
যাদের ধারণা আমি পুরুষকে খুশি করতে, ওদের প্রিয় হতে পুরুষকে বড় করি তাদের বলবো, আজকের এই ফেসবুকের যুগে এমন প্রশ্ন মনে আসাটাই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু যদি একথা সত্য ও হয় তবে আমার প্রশ্ন, আমি পুরুষকে সম্মান না করলে, ওরা কেন আমাকে সম্মান করবে? এটা কি যেকোনো স্বাভাবিক মায়ামমতার ভিত্তি নয়? এই সাধারণ বোধটাই আজ আমাদের সমাজে, গোটা বিশ্বে হারিয়ে গেছে। আমি নারীর অধিকার নিয়ে লিখি না। আমি পারস্পরিক ভালোবাসা, মায়ামমতা, শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে লিখি। অধিকারের প্রশ্ন আসলেই বিরুদ্ধাচরণ আসবে। আমি সেই পর্যায়ে যাই না। নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক আদায় এইসব আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমি যেখানে দু’জন মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক গতীয়মান, যেখানে একটা সুন্দর জীবনযাপন সম্ভব তাদের নিয়ে লিখি। আমি নারী, তাই পুরুষের প্রতি নারীর কর্তব্যকে, অনুরাগকে প্রকাশ করাটাই আমার জন্য সহজ, স্বাভাবিক।
পুরুষের নারীর প্রতি কি কর্তব্য তা নিয়ে অনেক পুরুষই লিখছেন, কিন্তু আজ আর তা প্রাণ থেকে নয়! হয়তো একদিন নারীর জন্য এমন কোনো পুরুষ উঠে আসবে। আমাদের সমস্যা হলো আমরা অন্যকে জোর করে শেখাতে চাই আমাদের একের প্রতি অন্যের কি কর্তব্য। পুরো সমাজই এক জেদাজেদি চক্রে ঘুরছে। তাহলে কিভাবে গড়ে উঠবে নারী পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক? আরেকটা কথা, নারী দুর্বল, অবলা, এইসব কথা ছাড়তে হবে। সেদিন গেছে। এইসব বলে বলে আর কতো? সমস্যা হচ্ছে আধুনিক নারী তার নিজের জায়গা থেকে সরে পুরুষের ভূমিকা নিতে চাইছে, তাই পুরুষ পুরুষের জায়গা থেকে সরে জন্তু জানোয়ারের ভূমিকা নেভাচ্ছে! কেবল বাইরে থেকে দেখলে হয় না, ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। যেকোনো কারণেই হোক পুরুষের নারীর উপর আধিপত্যকে আমি খারাপভাবে দেখি না। বরং আমার এই ব্যাপারটা অসাধারণ মনে হয়। হ্যাঁ আমি নারীকে, নারীবাদকে নিয়ে ঠাট্টা করি, আমি নারী বলেই তা করি। মেয়েরা একটা সহানুভূতির থালি নিয়ে চলে, সেটাকে আমি দুর্বলতা মনে করি। বারবার নিজেকে দুর্বল উচ্চারণ করাটা কোনো সবলের লক্ষণ নয়, এতে করুণা বৃদ্ধি হয় মাত্র, কিন্তু তাতে উন্নয়ন হয় না।
লেখক : লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
এইচআর/এমএস