কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা
একটা উদাহরণ থেকে শুরু করি। এক অফিসের অসুস্থ কর্মকর্তা তার বসকে জানালেন, “স্যার, আজ আমার শরীর ও মন খুব খারাপ। অফিসে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। ছুটি পেলে ভালো হতো”। বসের জবাব, “তোমার শরীর খারাপ হলে কিছু করার নেই। ছুটি পাবে। কিন্তু তোমার মানসিক সমস্যার দায় অফিস নেবে না”। এটা হচ্ছে, আমাদের কর্মস্থলের সাধারণ চিত্র। পাওনা ছুটি থাকার পরও আমরা এ ধরনের তাচ্ছিল্যের শিকার। কিন্তু কেন? এটা কি স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, নাকি অস্বাভাবিক মানসিকতার প্রকাশ?
স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখা কর্মস্থলের সবার জন্য জরুরি। আর সেটা হলো- শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকাকেই স্বাস্থ্য বা সুস্থতা বলে। কেবল রোগের অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয়। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অনেক কর্মক্ষেত্রেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন দুর্ঘটনা ঘটে। একটু ভেবে দেখি তো, যখন আমরা হঠাৎ গুরুতর শারীরিক রোগে আক্রান্ত হই, তখন কি আমরা স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে পারি? গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও তাই। এ ব্যাপারে যারা সচেতন, সমস্যায় পড়লে দেরি না করে তারা বিশেষজ্ঞের কাছে যান। এক্ষেত্রে অনেকেরই ভুল ধারণা, যারা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে ভালো কাজ আশা করা যায় না। অথচ একজন ডায়াবেটিক রোগী যেমন চিকিৎসার মধ্যে থেকে কাজ করতে পারেন, তেমনি একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিও মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মধ্যে থেকে অন্য সবার মতোই কাজ করে যেতে সক্ষম। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিনি একজন সুস্থ ব্যক্তির চাইতেও বেশি দক্ষতা দেখাতে পারেন। অনেকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থও হয়ে ওঠেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতার দায়ভার কার? ব্যক্তির নিজের, না প্রতিষ্ঠানের?
একজন ব্যক্তি যদি তার পেশাকে সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাছাই করেন, তবে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা তার জন্য সহজ হয়। সেক্ষেত্রেও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। কাজে মানসিক প্রশান্তি অনেকটা নির্ভর করে সহকর্মীদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক, তত্ত্বাবধায়ক বা নিকট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সুসম্পর্ক, প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা, সুযোগের ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের দক্ষতার বিকাশ এবং সর্বোপরি কর্মস্থলে নিজের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতন থাকার ওপর।
কর্মক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণে ব্যক্তির মধ্যে নিরানন্দ দেখা দিতে পারে, সরাসরি যার প্রভাব পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতায়। যেমন- অদক্ষ বা নিষ্ক্রিয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অতিরিক্ত রাগী বস, প্রতিষ্ঠানের বেতন অনিয়মিত হওয়া, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা অথবা কাজের চাপ, দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ না পাওয়া, টিমের মাঝে সুসম্পর্ক বা তালমিল বজায় না থাকা।
একটি ভাল কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজেকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করতে পারবে, সহযোগিতামূলক পরিবেশ পাবে, একে অন্যকে সম্মান দেখাবে, তবেই কর্মক্ষেত্র পূর্ণতা পাবে। এর সুফল পাবে পুরো প্রতিষ্ঠান। হতে পারে একজন কর্মী কারণে-অকারণে অফিসে না আসার বাহানা করছেন বা প্রায়ই দেরি করে আসছেন। সেক্ষেত্রে সহসাই কর্মীকে দোষারোপ না করে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, কী কী কারণে এমনটি ঘটতে পারে। সবাই কি অফিস এটিকেট বা আচরণবিধি মানছেন! না-কি শ্রেণি বৈষম্য প্রকট আকার নিয়েছে! কর্মীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস করবেন, তখনই প্রতিষ্ঠানের উত্তোরোত্তর উন্নতি হতে থাকবে। বোঝা যাবে, প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক বিভাগ সচল আছে। একজন কর্মী কীভাবে ভাবছেন, কী আচরণ করছেন, তার সবটুকুই প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে প্রভাব ফেলে। কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্বারোপ করা তাই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুতে সবার আগে আসে কর্মক্ষেত্রে বুলিংয়ের বিষয়টি। বুলিং বলতে বোঝায় কাউকে কথা দিয়ে, শারীরিক নির্যাতন বা অন্য কোন কাজের মাধ্যমে মানসিকভাবে অথবা সামাজিকভাবে হেনস্তা করা; তার কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা আদায় বা অবমূল্যায়ন করা। হতে পারে এটা মালিক পক্ষ করছেন বা ঊর্ধ্বতন কেউ অথবা কয়েকজন মিলে। বুলিংকারী যেভাবে বুলিং করে-
আমরা দেখতে পাবো বুলিংকারী একাধিকবার বাজে মন্তব্য করছে বা মজা করছে, হতে পারে কারো কাজ, পরিবার, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মীয় ভাবধারা নিয়েও; অথবা কারো ক্ষতি করছে বা করার চেষ্টায় রত; খারাপ মন্তব্য বা প্রস্তাব, যা যৌন নির্যাতনের ইঙ্গিত দেয় অথবা ব্যক্তিকে অপ্রস্তুত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে; মনস্তাত্ত্বিক খেলায় মাতা বা দল পাকানো কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করা বা লজ্জা দেয়ার উদ্দেশ্যে; এমন কথা বলা বা হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো যাতে নির্যাতিত ব্যক্তি কর্মস্থলে নিজেকে তুচ্ছ বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে; জেনে বুঝে এমন সব কাজ দেওয়া, যা সম্পন্ন করতে পারবেন না বা সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেই; বারবার কাজের রুটিন ও পরিকল্পনা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা; জেনেশুনে কাজের তথ্য নিজের কাছে রাখা, যাতে তিনি ঠিকমত কাজটি শেষ করতে না পারেন; সবসময় তাড়া দেয়া এবং অন্যের কাজ ও পদোন্নতির বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা; অপমানজনক দীক্ষা দেওয়া ইত্যাদি।
বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তির মধ্যে যে সব সমস্যা দেখা দেয়, তা হলো- কাজের গতি কমে যাওয়া, ব্যর্থতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ভয় পাওয়া, বারবার ভুল করা, বিষণ্ন থাকা, কাজে অনীহা, সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হওয়া, নিজের যোগ্যতা নিয়ে অবিশ্বাস তৈরি হওয়া, প্রতিষ্ঠানের বা মালিক পক্ষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা, মাথা ব্যথা, পিঠ ব্যথা, ঘুমের সমস্যা হওয়া ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে তাই প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। তাহলে প্রতিষ্ঠান ও কর্মী উভয়েই লাভবান হবে। কর্মীরা যথাযথভাবে মানসিক চাপ মোকাবেলা করে নিজের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে পারবেন। উন্নত বিশ্বের শ্রম ব্যবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা যে কয়টি বিষয় বিবেচনায় নিতে পারি, তা হলো-
১.কর্মস্থলে সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা। প্রকৃতিগতভাবেই সবার বিশ্রামের প্রয়োজন। কর্মীর বিশ্রাম থেকে শুরু করে তার জীবনযাপনের মানের প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে।
২. ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং নিয়মিত ভালো কাজের পুরস্কার দেওয়া। একজন তত্ত্বাবধায়ক তার অধীনস্থের অনেক ব্যক্তিগত গোপন তথ্য জানতে পারেন। পেশাগত নীতি মেনে সেসব তাকে গোপন রাখতে হবে। তাহলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে। একজনের কাজের পুরস্কার যেন অন্যজন না নিয়ে যান, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। সুষ্ঠু বিবেচনার মাধ্যমে কাজের পুরস্কার দিতে হবে। কাজের ফলাফল খারাপ হলে কর্মীকে সরাসরি দোষারোপ না করে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা সংবলিত পোস্টার অফিসের ভেতরে দেয়ালে টানিয়ে রাখা যেতে পারে, যাতে করে অফিসের সবাই প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে পারেন। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা যে কোন দুর্যোগের চেয়ে কম ভয়াবহ না।
৪. মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা। একজন ব্যক্তি বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, রাগ নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস অর্জন, বুলিং প্রতিরোধ ছাড়াও মানসিক সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাবেন এবং সমস্যায় পড়লে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবেন। সর্বোপরি, কাজের প্রতি কর্মীদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে ও মনোবল বাড়বে। কাজের পরিবেশ সুন্দর হবে, সহিংসতা, বৈষম্য ইত্যাদি কমে আসবে এবং প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধশালী হবে।
লেখক: চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ।
[email protected]
এইচআর/এমএস