ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা : আর কতদূর?

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ০৩:৪৯ এএম, ২৭ জুলাই ২০১৭

বহুদিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কাছে একত্রিত বা সম্মিলিত উপায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের জন্য দেনদরবার বা অনুনয় বিনয় করা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অন্যদিকে, পত্রিকা মারফত গত বছর আমরা জেনেছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৭ সাল থেকেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নাকি চিঠি দিয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত এ যৌক্তিক চাওয়া বরাবরের মতো এবারও উপেক্ষিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি পরীক্ষার যে তারিখ এবারে ঘোষিত হয়েছে সেটা বরাবরের মতোই যা হয় সেটাই হয়েছে। এক একদিন এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তার অর্থ হচ্ছে, যেরকম ভোগান্তি ভর্তিচ্ছু ছেলে-মেয়েগুলো প্রতি বছর পায় এবারও সেটাই পেতে চলেছে। অথচ সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এ ব্যবস্থা থেকে ছেলে-মেয়েদেরকে মুক্তি দিতে পারতো সহজেই। সেটা এবারও হলো না দেখে ভীষণভাবে হতাশ হলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়াতে গিয়ে ভুক্তভোগী ছেলে-মেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের কি যে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃখ সহ্য করতে হয়- সেটা আমরা সকলেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি। ছেলেরা তবুও কোনমতে এখান থেকে দৌড়ে সেখানে নানা ঝক্কিঝামেলা পার করে পরীক্ষা দিতে ছুটে যেতে পারে। কিন্তু মেয়েদের বেলায় তা তো সহজ নয়! আবার অন্যদিকে গরীব কিন্তু মেধাবী ছেলে-মেয়েরা তো টাকার অভাবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়টা তো আরো পরের ব্যাপার। আর শুধুমাত্র এ কারণেই অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার, ভাবা যায়? আজ যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা থাকতো তাহলে এমন বঞ্চনার ক্ষেত্র কী তৈরি হতো বা হতে পারতো? নিশ্চয়ই না।

যে ভর্তি পরীক্ষা একাধারে মেধাবী এবং গরীব ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারে না এবং যারা দিতে পারে তাদেরও নানা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা যুগ যুগ ধরে নেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে- আমি ভেবে ভেবে একদমই তার কিনারা পাই না। আমি নিজেও একসময় ভর্তি ভর্তি এ যুদ্ধ নামক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। যদিও সমন্বিতভাবে আয়োজিত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য দেশের নানা স্থানে ছুটে বেড়াতে হয়নি। ভাগ্য আমার ভালোই বলতে হবে বৈকি! মেডিকেল কলেজে চান্স না পেলে তো না ছুটে উপায় ছিল না।

দেশের অন্যতম মেধাবী মানুষ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত তারা ছেলেমেয়েদের এমন কষ্টের কথা বোঝেন না বা জানেন না ব্যাপারটা তেমন নয় মোটেও। কারণ তাদের চোখ কান তো সতত খোলা। কিন্তু লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য যে অমানবিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে তাদের সে ভোগান্তি লাঘবে তাহলে তাদের উদ্যোগী হতে বাধা কোথায়?

আমরা নানা কাজে দীর্ঘসূত্রিতা বা সিদ্ধান্তহীনতার জন্য দেশের আমলাতন্ত্রকে দায়ী করে থাকি। কিন্তু সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে তো আমলাতন্ত্রের কোন বাধা আমরা এখানে দেখছি না। তাহলে বাধা কোথায়? উত্তর হচ্ছে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সম্মানিত বিবেকবান শিক্ষকদের অনেকের অনীহাই এখানে একমাত্র বাধা; বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা সেটাই জানতে পেরেছি। যদিও সম্মানিত অনেক শিক্ষক কিন্তু ছেলে-মেয়েদের এ ভোগান্তি লাঘবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে বিভিন্ন সময়ে তাদের জোরালো মতামতও তুলে ধরেছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সালে ড. জাফর ইকবাল স্যারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কর্তৃক সিলেটের শাহজালাল এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে একত্রে করে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের উদ্যোগ। এটাই বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে একমাত্র সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার লক্ষ্যে প্রথম এবং সর্বশেষ ভালো উদ্যোগ ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার যে , সেটা হতে দেয়নি সিলেটের বিবেকবান (!) মানুষেরা। এখানে ডান-বাম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। দাবি একটাই। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। যে সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ এখনও বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের জোরালো মতামত তুলে ধরে থাকেন তারা এ ব্যাপারে আরো বেশি সোচ্চার হবেন যেন সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কারণ আমরা এখন জেনে গেছি কি হতে যাচ্ছে এবারও!

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মারফত দেখতে পাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ার পেছনে অর্থই নাকি অনর্থের মূল। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকবৃন্দ ভর্তি পরীক্ষা থেকে ভর্তি ফরম বাবদ যে মোটা অংকের টাকা আয় করে থাকেন সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা হলে তারা এই অর্থ উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে এই লোকসান মানতে রাজি নন। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে উনাদের এত অনীহা! শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারের লেখাতে নানা সময়ে এ বিষয়টা উঠে এসেছে। তাহলে সরলীকরণ করলে দাঁড়াচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম হচ্ছে অত্যন্ত সস্তা উপায়ে টাকা আয়ের এক অমানবিক উপায়। আর সে সহজ আয়ের উপায় বাঁচিয়ে রাখতেই এমন অমানবিক পন্থা সচল রাখতে সম্মানিত বেশিরভাগ শিক্ষক জোটবদ্ধ হন। শুধুমাত্র নিজেদের পকেটে টাকা ঢোকানোর জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষকেরা এমন একটা অবৈজ্ঞানিক, সেকেলে উপায় বাঁচিয়ে রাখতে ডিজিটালাইজেশনের এ যুগেও কিভাবে তৎপর থাকেন ভাবলে রীতিমত অবাক হতে হয়!

অথচ, ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে এক বৈঠকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই বৈঠকে চার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি কমিটি, পাঁচটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি এবং চারটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটিসহ মোট তিনটি কমিটি গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এছাড়া একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিলো ২০১৬ সাল থেকে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। (সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন, ২০ আগস্ট, ২০১৬)। কিন্তু অদ্যাবধি কাজের কাজ কিছুই হলো না। দুঃখভরা মন নিয়ে পুরোনো প্রক্রিয়া এ বছরও দেখে যেতে হচ্ছে।

তথ্য প্রযুক্তির এমন উন্নয়নের কালে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠান তাই সময়ের দাবি। যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত এমন দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান শিক্ষকেরা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন- লাখ লাখ ভর্তি পরীক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ তেমনটাই প্রত্যাশা করে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন