ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমাদের নারীরা কবে নিরাপদ হবে

প্রকাশিত: ০৭:৪৮ এএম, ২৭ মে ২০১৫

আমাদের নারীরা কবে নিরাপদ হবে? দেশে ধর্ষণ! ধর্ষণের পর খুন! এ জাতীয় যৌন-ব্যভিচার কি বন্ধ হবে না? মানুষরূপী নরপশুরা সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে কি হায়েনার নখ মেলেছে? শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। খোদ রাজধানীতে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে গারো মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে (২২ মে), এর দু’দিনের মাথায় এবার ট্রাকে আরেক নারী শ্রমিককে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে (২৩ মে), নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসে খালুর হতে ধর্ষিত হয়েছে এক তরুণী (২৪ মে)। এর এক সপ্তাহ আগে চলতি মাসেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন এক পোশাককর্মী। এমনকি বর্ষবরণের দিনও টিএসসিতে জনসমক্ষে নারীর শ্লীলতাহানি ঘটে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নারীকে শিকার হতে হয় পুলিশি নির্যাতনের। তাদের ঘৃণিত এই কাজ অপরাধবিজ্ঞানের কোন্ সংজ্ঞায় ফেলা যাবে?

দেশে নিত্যই ব্যভিচার ও ধর্ষণকামিতার ঘটনা ঘটছে তো ঘটছেই। যৌন নির্যাতন করছে কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারি, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া; গৃহবধু। রাস্তা ঘাটে, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। যৌন হয়রানী এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিনদুপুরে প্রকাশ্য ধষর্ণের ঘটনাও ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশীসংস্কিৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হালআমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। শুধু ধর্ষণই নয়, দেশে ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে অহড়হ। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি চির অবধারিত। এ ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম প্রধান কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নির্ন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যাঁরা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাঁদের ছুঁতে পারে কম। যাঁরা নিম্নবর্গের বাসিন্দা, তাঁরা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে একাধিকবার চলন্ত বাসের ভেতর নারীর ওপর গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের হার ভারতের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সারা বছর ধর্ষণের ঘটনা নারী নির্যাতনের শতকরা ১৮ ভাগ, যা ভারতে ৯.৫ ভাগ। এছাড়া শুধু ঢাকায় সারা বছরে ধর্ষণের ঘটনা মোট নারী নির্যাতনের শতকরা ২০.৪৬ ভাগ, যা নতুন দিল্লীতে ৯.১৭ ভাগ। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অধিকাংশই এখনও তাঁদের ওপর নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার কথা প্রকাশ করতে চান না। আর ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা পুলিশের কাছে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করেন। তাই সরকারের খাতায় প্রতিবছর যতগুলো ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন সমাজবিদরা।

ধর্ষণ বৃদ্ধি হওয়ার জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতা দায়ী। কারণ অন্যায়কারী এমন জঘৃণ্য অন্যায় করার পরও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে নীরব থাকে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। কারণ যারা এর শিকার হন তারা সবাই দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে, তাই আইনও এদের পাত্তা দেয় না।  মেয়েদের প্রতি পদেই বিপদের মোকাবিলা করতে হয় আজকের সমাজে, শ্রেণীবিভাগ ব্যতিরেকেই। উচ্চবর্গিয়রা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে ঘরের মধ্যে তাদের বিপদ কিছু কম হতে পারে তবে পার্টিতে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতের হাতে, আর ঘরে নিকট আত্বীয় বা পরিচিতজনদের হাতে লাঞ্ছনা জোটার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসল সমস্যাটা হলো কুরুচিপূর্ণ পূরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সেটা কোনো শ্রেণিভাগ মানে বলে মনে হয় না। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী কিংবা ডাক্তারনী ধর্ষিত হয় কি করে?

যৌন-ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্মমতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণের চূন্তান্ত শাস্তিবিধান মৃত্যুদনণ্ড। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে নিশ্চিত হলে হত্যাকারীর শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু  এ যাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হয়েছে এরূপ নজির কমই আছে। হয় চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শিকার ও হয়রানির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে।

দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? এ প্রশ্ন কাউকে করলে  আনেকেই বলেন- ভাল মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না ; পোশাকের সমস্যার কারণে মেয়েরা ধর্ষিত হয়। অনেকে আবার বলেন বেহায়াপনা করে  স্বল্প কাপড়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে ধর্ষণ হবে না তো কি হবে? আবার অনেকে বলবেন- ‘কঠোর শাস্তি দিলে ধর্ষণ কমবে।’  আসলে যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানুসিকতা বদলাতে হবে ।

সব দোষ নারীর? সব দোষ পোশাকের? এমন মানসিকতা কেন আমাদের। ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে । ধর্ষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে।  নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।  ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগও কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ মাদরাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 নারীর ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বাস্তবায়ন নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধ প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিই বেশি  জরুরি। সে লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। মনে রাখতে হবে ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরেই বহু কর্মজীবী নারীকে সন্ধ্যার পর কর্মস্থল থেকে একাকী ঘরে ফিরতে হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এমনটা মানুষের প্রত্যাশা।

ধর্ষকদের ধরতে হবে প্রথমে, এরপর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে নারীরা ঘরের বাইরে নিজেদের নিরাপদ ভাবেন। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

লেখক : সাংবাদিক ।

পিআর