বিএনপি এখন কী করবে
টানা তিনমাস বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট হরতাল-অবরোধের নামে দেশে কী অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে খুব সহজে হারিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। অবশ্য ২০১৩ সালেও পেট্রলবোমায় মানুষ মারা, যানবাহন পোড়ানো, অবরোধের নামে ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহর-বন্দরকে বিচ্ছিন্ন করার একটি পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের আন্দোলন করেছিল জোট। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও বানচাল বা প্রতিহত করা যায়নি। একটি আক্রান্ত নির্বাচন কোনো প্রকারে ঘরে তুলে আনা সম্ভব হলো। সেটি করা সম্ভব না হলে দেশে হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতোই। তা থেকে বাঁচা গেল!
এবার ২০১৫ সালে সেই নির্বাচনী দিবসকে কেন্দ্র করে দেশে সরকারকে অচল করে দেওয়ার গোপন পরিকল্পনা নিয়ে ২০ দল আবার মাঠে নেমেছিল। সরকার সেটি ব্যর্থ করে দিতে বাধা দিলে বিএনপি নেত্রীর দিক থেকে লাগাতার অবরোধ এবং হরতাল ঘোষিত হতে থাকে। জোটের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া নিজে গুলশান কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে আন্দোলনটিকে ভিন্নমাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তাতে ‘অফিসবন্দী নেত্রীর’ প্রচারণায় দেশে-বিদেশে সরকার উৎখাতের কোনো আবেদন সৃষ্টি করা যায় কি-না তেমন চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটিতে জোট তেমন সফল হয়নি। কেননা, সেই আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতা নিয়ামক ছিল, সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার মতো কোনো জায়গা ছিল না।
ফলে দ্রুতই অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি ভোঁতা হয়ে পড়ে। মানুষ ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে জীবন-জীবিকায় নেমে পড়ে। গোপন জায়গা থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব কর্মসূচি ও বার্তা প্রেরণ করেও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেননি। বিএনপি এবং ২০ দলের কর্মসূচিতে সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং প্রতিহিংসা মূখ্য ছিল। এতে হঠকারী অতিবিপ্লবী চরিত্র আগাগোড়া ফুটে ওঠে। এই আন্দোলন ভোট, ভাত বা গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার জন্যে নয়, বরং সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রহঠকারী গোষ্ঠীর ক্ষমতা গ্রহণের ইচ্ছা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অবশিষ্ট অংশকে ধ্বংস করে দেওয়ার ধারণাই বিশেষভাবে দিচ্ছিল। ফলে দেশের সচেতন মহল, বিদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ২০ দলীয় জোটের হিংসাত্মক কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানায়নি।
যখন কোনো রাজনৈতিক জোট পেট্রলবোমায় নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে দাবি আদায় করতে চায় তখন কোনো গণতান্ত্রিক শক্তিই পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারে না। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তা ছাড়া ২০ দলীয় জোট জামায়াত এবং এর কাছাকাছি মতাদর্শের কিছু দলের সমর্থন, সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র-বিরোধী নানা অপশক্তি যখন মিলেমিশে থাকে তখন স্পষ্ট বোঝা যায় এই আন্দোলন ‘সফল’ হওয়ার করুণ পরিণতি দেশের জন্যে কী হতে পারে। যুুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার লক্ষ্য থেকে জামায়াত ২০১০ সাল থেকে দলটির ক্যাডার বাহিনীকে যেভাবে উগ্রজঙ্গিবাদী মতাদর্শ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণে তৈরি করেছিল তার প্রমাণ বিগত বছরগুলোতে এ জোটের কর্মকাণ্ডেই পাওয়া গেছে।
ফলে সচেতন মহলে বিএনপির সরকার-বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং সন্দেহ তৈরি হতে থাকে, প্রশ্ন জাগে যে, বিএনপি আদৌ গণতন্ত্রের আদর্শকে ধারণ করে কি-না, যদি না করে, তাহলে এ জোটের হাতে পড়ে বাংলাদেশ তার গণতন্ত্রের অবশিষ্টাংশও হারালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ ধরনের ধারণা বিগত বছরগুলোতে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের নেপথ্য শক্তি, অর্থ ও সমর্থনদাতাদের বিষয়টি কারো কাছেই শেষ পর্যন্ত অজানা থাকেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি গণহত্যা সংঘটিত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কোনো নীল-নকশা বা কৌশল ছিল না- এমনটি বলা যাবে না। অথচ বিএনপি এমন পথে না গিয়ে, নিয়মতান্ত্রিক পথে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সামগ্রিক বাস্তবতা তৈরি হতো, তাতে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটতো, সরকার জোরজবরদস্তি করে একেবারে পার পেয়ে যেতো- তা সহজে বলা যাবে না।
কিন্তু বিএনপি গণতন্ত্রের এমন পরীক্ষিত পথে না গিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করতে সন্ত্রাসবাদী ধারার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করলো। ২০১৫ সালেও সেটিরই দলটি পুনরাবৃত্তি করলো। সকলেরই জানা বিষয়, সরকার উৎখাতের মতো কোনো ‘আন্দোলন’ ব্যর্থ হলে তাতে অংশগ্রহণকারী দল, দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাকে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অবৈধ বা অগণতান্ত্রিক বলে দাবি করে না।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের এসব সহিংস কর্মসূচি মোকাবেলা করেছে, তাতে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা মোকদ্দমা ও বিচারিক কার্যক্রম চলছে তা না করে কি সরকারের সম্মুখে কোনো উপায় ছিল? সরকারকে তার বৈধ পথ অনুসরণ করতে হবেই। আওয়ামী লীগ সরকার সেক্ষেত্রে যথেষ্ট শিথিলতা প্রদর্শন করেছে। নিরপেক্ষভাবে বিচার করে বললে বলতে হবে বিএনপির কর্মকাণ্ডগুলোতো মোটেও গণতান্ত্রিক ছিল না। ফলে ‘আন্দোলন’ ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে, পেট্রলবোমায় পোড়াপুড়িতে যুক্ত থাকার অভিযোগে অনেকে নানা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছেন। এমন আন্দোলন করার কারণেই একটি ভিন্নতর পরিস্থিতি দলের জন্যে তৈরি হয়েছে। এর দায় কার? সরকারেরই বা তাতে দায় কতোটা? বিএনটির দায় কতোটা? এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সকল মহলের মধ্যেই থাকতে হবে।
এরই মধ্যে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়েও বিএনপির অবস্থান ছিল একেবারেই লেজেগোবরে। ফলে সেখানেও নেতাকর্মীরা স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। কেননা, দল এখানেও স্পষ্ট করেনি যে তারা আসলে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল কি-না? হঠাৎ নির্বাচনের দিন তিন মেয়র প্রার্থীকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাটি হঠকারী বলে সকলের কাছেই মনে হয়েছে।
এখানেও দলের মূল নেতৃত্বের মধ্যে অন্য কোনো লক্ষ্য বা চিন্তা কাজ করেছিল বলে মনে হয়েছে। ফলে দল আরো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। দলের সাধারণ কর্মী, নেতা ও সমর্থক, এমন কি ভোটার গোষ্ঠী আশাহত হয়েছে। দলের মূল নেতৃত্ব এখন এ সবের মূল্যায়ন কতোখানি করছেন তা মোটেও স্পষ্ট নয়। তবে বিএনপির ভেতরে এখন নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো কোনো নেতার কথায় এটি বোঝা যাচ্ছে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা, এর বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ নিপীড়ন চালিয়ে বিএনপিকে দুর্বল করে দিলে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সেই শূন্যস্থান পূরণ করে নেবে বলে যে মন্তব্য করছে তা খুবই সরলীকরণকৃত। বিএনপির মতো এতো বড় একটি দলকে সরকার চাইলেই তছনছ করে দিতে পারে না। তবে বিএনপির বিবর্ণতার মূল কারণ কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বের হঠকারী, গণতন্ত্রচ্যুত কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। বিএনপিকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে দলটি কি গত ৫-৬ বছরের রাজনৈতিক কৌশলে চলবে, না-কি বিশ্ববাস্তবতা এবং বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতার চাহিদা মোতাবেক রাজনীতি করবে।
কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি এখন জামায়াত থেকে বের হতে চাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির অভ্যন্তরে জামায়াত-হেফাজতের অবস্থান বিগত বছর গুলোতে যেভাবে সংহত হয়ে আছে, তাকে ভেঙে দলটি নিরেট গণতন্ত্রের মতাদর্শে কতখনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে? যদি পারে, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পরিবেশে নতুনত্ব সৃষ্টি হবে। না পারলে বিএনপির সাংগঠনিক রূপ কেমন হবে- তা বলা মুশকিল।
তবে দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত নির্ভরশীলতার কারণে বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাঁড়াতে সুযোগ দেয়নি, একই সঙ্গে দেশে গণতন্ত্রের রাজনীতির পথও বাধাগ্রস্থ করেছে, সাম্প্রদায়িকতার কাছে দলকে আবদ্ধ করে রেখেছে। এখন বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের কী করা উচিত কী করা উচিত না। এক্ষেত্রে ভুল করলে এর মাশুল বিএনপিকে কড়ায়গড়াণ্ডায় গুণতে হতে পারে। আমরা চাইবো বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান দাঁড় করাক। তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সবল প্রতিযোগিতায় চলতে পারবে।
এইচআর/বিএ/এমএস