ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সৎবাবা কেন অসৎ হয়?

সাবিনা শারমিন | প্রকাশিত: ০৪:১৯ এএম, ২৩ জুলাই ২০১৭

মা বা বাবার দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রে একজন সন্তান মায়ের স্বামীর সাথে অথবা বাবার স্ত্রী'র সাথে একই পরিবারের সদস্য বনে যায়। ফলে তারা উভয়েই রক্তের সম্পর্কে আত্মীয় না হয়েও হয়ে যায় চাপিয়ে দেয়া কথিত সামাজিক আত্মীয়। একেবারে একই ছাদের নিচে এক পরিবারের সদস্য। স্বামী বা স্ত্রীর আগের পক্ষের সন্তানের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কের সূত্র বা সেতু শুধু ঐএকটিই। মায়ের সূত্রে 'মায়ের স্বামী' সৎবাবা, অথবা বাবার সূত্রে বাবার স্ত্রী সৎমা। 

মূলত এই সম্পর্কগুলোতে বায়োলজিকাল, অথবা আত্মিক সম্পর্ক না থাকার কারণে নৈতিকতা এবং মানবিক বোধই একমাত্র সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া অন্য কোনোরকম বন্ধন সহসাই তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে ওঠেনা । তাই আবেগ মমতাহীন এই বন্ধন ছাড়া সম্পর্কগুলো কখনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকাশ হয় না। ফলে সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে যায় শুধু স্বার্থ কেন্দ্রিক সম্পর্কে। ফলে সময় ও সুযোগে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কগুলো বৈরি আকারে রুপ নেয়। পিতামাতার সম্পর্কের টানাপড়েনে পরিবারের নিষ্পাপ শিশুরা সহসাই বলি হতে পারে সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি, মায়ের স্বামী কখনো বাবা নন। পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী কখনোই গর্ভধারিণী মা নন। আবার শুধু জন্ম দিলেই মা হতে পারেনা সকলে। তেমনি ঔরসজাত হলেই বাবা নন অনেকেই। 

আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থানে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া এই ধরনের সম্পর্কের ভিত শক্ত হওয়া খুব সহজ কথা নয়। তাই যে কোনো সময়েই তাসের ঘরের মতো ধ্বসে যেতে পারে একটি ঘর। তবে ব্যতিক্রম এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। অবক্ষয় রোধ আর মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বিকল্প নেই। পিতামাতার দ্বিতীয় বিয়ের সম্পর্কে সম্পর্কিত এই সম্পর্কগুলো কখনোই সরাসরি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, যেমন সৎবাবা-মেয়ে ,অথবা সৎমা- ছেলে, এভাবে ওয়ান-টু-ওয়ান ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গড়ে ওঠেনা। সম্পর্কগুলোকে আরেকটি সম্পর্কের উপর নির্ভর করে টিকে থাকতে হয়। ফলে উভয় পক্ষই এক ধরনের যাতনা, হীন ঈর্ষা এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে। প্রতিশোধ প্রবণতা অথবা সুযোগ সন্ধান করে আত্মসাৎ করার লিপ্সাও অনেকের মনে জেগে ওঠে। 

আমাদের সংস্কৃতিতে 'সতীন' বলে একটি তীক্ত সম্পর্কের শব্দ রয়েছে। শব্দটিতে ভালোবাসার মানুষকে হরণ করার অর্থ রয়েছে। একই স্বামীর একই সাথে দু'জন স্ত্রী থাকলে একে অপরের সম্বোধন হয় 'সতীন'। ওদিকে পাটিগণিতের সরল অংকের হিসেব মতে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও স্ত্রীর আগের স্বামীর সাথে নতুন স্বামীর সম্পর্কটি দাঁড়ায় অনেকটা অতীত সম্পর্কের জেরে বর্তমানের পুরুষ সতীনের সম্পর্কের মতোই। তাই সৎমায়ের আচরণের মতো স্ত্রীর আগের স্বামীর সন্তানের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক স্বাভাবিক না হয়ে হয় বিদ্বেষ এবং ঈর্ষাপরায়ণ। সম্পর্কের টানাপড়েনে তাই অনেক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমাদের সমাজও ভাঙা সংসারের এই শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি বিবেচনা না করে মায়ের নতুন স্বামীকে সন্তানের জন্য অভিভাবক হিসেবে জোরপূর্বক পিতা রুপে গছিয়ে দিতে চেষ্টা করে। নিরাপত্তাহীন এই শিশুদের অন্যের কাছে গছিয়ে দেয়ার ফল অনেক সময় এই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত জেদাজেদি এবং ইগোর শিকার হয় নির্দোষ সন্তানরা। ঘটে যায় হত্যা, আত্মহত্যা অথবা ধর্ষণের মতো দুর্ঘটনা। বিচ্ছেদের পরিণতিতে সন্তানদের জীবনের দুর্ভোগ উন্নত দেশে আমাদের দেশের মতো এতোটা করুণ নয়। 

আমাদের দেশের নারীরা যতোই যোগ্যতাসম্পন্ন হোক না কেনো লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে তাঁদের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থান দিনশেষে পুরুষের হাতেই তুলে দেয়া হয়। নারী পুরুষের চেয়ে অধিক উপার্জন এবং অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও নিয়ন্ত্রণটি থাকে পুরুষের কাছেই। তাই কোন পরিবারে একজন স্ত্রী যদি উপার্জনশীল না হয় এবং সে সাথে তার যদি আগের সংসারের কন্যা সন্তান নিয়ে বর্তমানের স্বামীর সাথে সংসার করতে হয়, তাহলে সে পরিবারে স্ত্রীর আগের ঘরের কন্যা সন্তানের দুর্ভোগের আর সীমা থাকেনা। পরিবারের কন্যা সন্তানটি তখন বিভিন্নভাবে অন্যান্য সদস্য দ্বারা যৌন নির্যাতনসহ আরো অনেক নিপীড়নের শিকার হতে পারে। কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে সে একটি ভঙ্গুর অবস্থানে অবস্থান করে। ফলে গর্ভধারিণী মাও তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরে যান দুর্বিপাকে। আর প্রাক্তন স্বামীর সন্তানের কারণে বর্তমান স্বামীর সংসার ও তার সন্তান অধিক গুরুত্ব পাবে, সেটিও মানুষের মনস্তত্ত্বের একটি দিক।

তবে এখানে বিচ্ছেদ হওয়া ঔরসজাত পিতার অন্তর্মুখিতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন একজন সন্তানের জীবন ধারণের আর কোন উপায় থাকেনা তখন এমন পিতার দায়িত্বহীনতা অনেকটাই বাবা মায়ের নতুন জীবনসঙ্গীকে নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে বাধ্য করে। আর মায়ের স্বামী খুব ভালো করেই জানে তার সাথে তার স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তানের সাথে কখনোই রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়। তাই নৈতিকতাও এখানে খুব সহজে পরাজিত হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে শিক্ষিত জন স্ত্রীকে ভালোবাসলে তার সন্তানকেও ভালোবাসবে। কিন্তু অনেক সময় মানুষের শিক্ষা প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে যায়। রক্ষক বনে যায় ভয়ংকর ভক্ষকে।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ে সম্প্রতি তার মায়ের স্বামী দ্বারা গত আট বছর ধরে নির্যাতিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সে দৃশ্যর ভিডিও ধারণ করতে ভুল করেননি মিডিয়া কর্মী আরমান সুমন। হয়তো আলু পটলের দোকানদার হলে ভিডিও ধারণের কথা তার মনে পড়তোনা। একটি নামকরা চ্যানেলের কর্মী হিসেবে ভিডিও ধারণ করে তিনি অত্যন্ত পেশাদারী মনোভাবের প্রমাণ দিয়েছেন। যেন সেই ধারণকৃত ভিডিওটি পুঁজি করে ভবিষ্যতে ব্ল্যাকমেইল করতে তার কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়। তাই তিনি তার পেশার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কাঙ্খিত কার্যোদ্ধার করার জন্য সুচারুরূপে রেকর্ড ধারণ করেছেন। শুধু তাই নয়, মেয়েটিকে তিনি একবার গর্ভপাত করাতেও বাধ্য করছেন। স্বামীর এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা মেয়ের মা'র অজানা ছিলোনা। তিনি সকল কিছু জেনেও ঘটনা গোপন করে গেছেন এবং তার মেয়েকে তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে এই সম্পর্ক চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। উপরন্তু তিনি ঘটনা গোপন রাখতে মেয়েকে চাপও দিয়েছেন। মেয়েটি এতোগুলো দিন এতগুলো রাত এতোগুলো ঘন্টা, এতোগুলো মিনিট, এতোগুলো সেকেন্ড ধরে এ যন্ত্রণা ভোগ করলো! 

গর্ভপাত যখন ঘটানো হ'লো তখন নিশ্চয়ই প্রয়োজন হয়েছিলো মেয়েটির মায়ের। কোথায় ছিলেন তিনি তখন? ওসময় কি কোন ডাক্তারের সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি? কোন আত্মীয়-স্বজনের দরকার কি পড়েছিলো? স্কুল শিক্ষক জানতে চাইলোনা মেয়েটি কেনো স্কুলে যায়নি? কোন প্রতিবেশি খালার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি একটু অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়লো না? মেয়েটির কি কোন একান্ত কাছের বন্ধু ছিলোনা যার কাছে প্রাণ খুলে সকল কথা বলা যায়? মেয়েটির বাবার সাথে মায়ের ডিভোর্স হয়েছে, কিন্তু মেয়েরতো একজন জন্মদাতা বাবা ছিলো। মায়ের সাথে ডিভোর্স করা যায়, সন্তানের সাথেতো কোন পিতামাতার ডিভোর্স হয় না। তা'হলে মেয়েটির বাবা কেন তার কন্যার দায়িত্ব নিলেন না? নিজ সন্তানকে কেনো তিনি স্বর্ণলতা বানালেন? বিচ্ছেদ হলে কেনো সন্তানের এই দায় ভারটা কখনোই সন্তানের বাবা পালন করেন না? আমাদের আশেপাশে এমন অনেকে আছে যারা সন্তানের দায়িত্বতো নেয়ই না, সন্তানের প্রতি কর্তব্যটুকু অস্বীকার করে। সন্তানের বিয়ের সময়েও পিতা উপস্থিত থাকেনা। অথচ কন্যা তার নামের সাথে পিতার নাম যুক্ত রেখেই কাটিতে দেয় সারাজীবন। আমাদের সমাজে এ সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেরই মতামত হচ্ছে, যেখানে নিজ পিতাই ধর্ষক বনে যান, সেখানে আবার সৎপিতা!! 

আবার অনেকেই বিষয়টিকে ঘৃণা দিয়ে পাশ কাটিয়ে কথাই বলতে চান না। তারা বলতে চান এসব নিয়ে কথা বলাও রুচিহীন ব্যাপার। কারণ বিষয়টি সভ্যতার পরিপন্থী, ঘটনাগুলো অগ্রহণীয়। কিন্তু তাই বলে কোনোভাবেই বলা যাবেনা এ ধরনের ঘটনা নিয়ে আমি কথা বলবো না। কারণ আমরা হয়তো ভাবি আমাদের কন্যারতো এমন ঘটনা ঘটবেনা। তাই এ নিয়ে কথা বলবোনা। তাদের জন্য আমার একটি কথা,আমার আপনার পরিবার হয়তো এক একটি পৃথক পরিবার, কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কিন্তু এক। আমার পরিবারে না ঘটলেও আমার স্বজনের পরিবারে কিন্তু ঘটে যেতে পারে এমন একটি দুর্ঘটনা। তাই আশঙ্কাজনক পুনরাবৃত্তি ঘটে যাবার আগেই সবচেয়ে আগে ঘুরে দাঁড়াতে হবে মাকে। দায় নিতে হবে বায়োলজিকাল পিতাকে। প্রয়োজনে বিচ্ছেদ হওয়া সন্তানের ভরণ পোষণের জন্য নতুন আইন হোক, এবং এই সম্পর্কগুলোর উন্নয়নের জন্য কাউন্সেলিং সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক ।

লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন