তাহসান-মিথিলা ডিভোর্স, অন্যদের সমস্যা কী?
ডিভোর্স মানেই দুঃসংবাদ অমন একটি ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের অনেকের মনে। কখনও কখনও ডিভোর্স দুঃসংবাদ তো নয়ই বরং সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা আর একত্রবাস করতে চাইছে না, এক ছাদের নিচে চাইছে না থাকতে, কোনওভাবেই আর দাম্পত্যটাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে না, যারা প্রবলভাবে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে একে অপর থেকে। কখনও কখনও একত্রবাস, দুঃসহবাসও হতে পারে। এই দুঃসহবাস থেকে বেরিয়ে আসতে, মুক্তি পেতে, ডিভোর্সের বিকল্প নেই কোনও। ডিভোর্স তাই কখনও কখনও মুক্তিও বটে।
খবরের কাগজে প্রতিদিন অসংখ্য লোহমর্ষক ঘটনা। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে নৃসংশভাবে হত্যা করছে, পুড়িয়ে মারছে, এসিড নিক্ষেপ করছে, ছুরিকাঘাত করছে, পুরুষাঙ্গ কেটে নিচ্ছে; এমনকি হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করছে। করে তা স্বীকারও করছে। কেবল নিন্মবিত্ত নয়, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রায় সকল বিত্তের বৃত্তেই ঘটছে এসব ঘটনা। এসব ঘটনার কিছুই ঘটতো না, অমন নৃসংশতা, বীভৎসতার কিছুই হতো না, যদি একত্রবাস না করে, বিচ্ছিন্নবাসের সিদ্ধান্ত নিতো তারা আরো আগে।
সোসাইটি খুব এন্টি ডিভোর্স এখানে। ডিভোর্স ব্যাপারটিকে খুব নৈতিকভাবে দেখা আমাদের স্বভাবজাত। দু’টো মানুষ একসঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকাটাকেই ভীষণ জরুরি মনে করি আমরা। মনে করি ‘একত্রবাস’ সুখের একমাত্র উপায়। একসঙ্গে আছে, তার মানে সুখে আছে। ফেসবুকে যুগল ছবি দিচ্ছে, তার মানে ‘দে আর হ্যাপি কাপল’। আমরা অন্তর্মুখি না, বহির্মুখি। কেবল উপরি কাঠামো দেখি। মানবিকতার চেয়ে লৌকিতার গুরুত্ব বেশি দেই। লোক দেখাতে, ভান ভণিতা করতে পছন্দ করি। ‘নিজে কেমন আছি’র চেয়ে লোকে কি ভাবছে আমাকে নিয়ে তা আমাদের ভাবনায় অধিকমাত্রায় ক্রিয়াশীল। ফলে লোক দেখাতে কৃত্রিম আচরণ করি। ভালো না থেকেও ভান করি, ভালো থাকার।
বিয়ে এবং দাম্পত্য এখনও এ সমাজে ট্যাবু। ব্যক্তি বিয়ে যতটা না করতে চায়, চারপাশের সমাজ তাকে বিয়ের দিকে আরো বেশি ঠেলে দেয়। আর প্রেম করলে তো রক্ষে নেই। বিয়েই তার একমাত্র পরিণতি বলে ভাবি। কখনও কখনও প্রেমের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক নাও হতে পারে। হয়তো দু’জন কেবল প্রেমই করতে চায়, বিয়ে নয়। কিন্তু তা মানতে নারাজ সোসাইটি। ফলে কখনও কখনও প্রেমের পর বিয়েতে পৌঁছে সম্পর্কটি আর আগের মত থাকে না। কেননা, প্রেম আর বিয়ে দু’টোর ধরনও কাঠামো এক নয়। ফলে অনেক সময় সফল প্রেম, অসফল দাম্পত্যে রূপ নেয়।
বিয়ে কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও নয়। একটি সামাজিক ও আইনি চুক্তি। যে কোন চুক্তি ভেঙে যাবার আশঙ্কা ও সম্ভাবনা থাকে বলেই সেখানে সই-স্বাক্ষর লাগে, কাগজপত্র লাগে। বিয়ের ক্ষেত্রেও তা-ই। কোন সম্পর্কই স্থায়ী নয়, চিরস্থায়ী তো নয়ই। সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন হওয়া অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। যে কোন সম্পর্ক যে কোন কারণে ভাঙতেই পারে। মহাভারতের বনপর্বে বকরুপী ধর্মের একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল যুধিষ্টির কে। সেখানে অন্যতম প্রশ্ন ছিল ‘বায়ু অপেক্ষা শ্রীঘ্রগামী কে? যুধিষ্টির উত্তরে বলেছিলেন, মন বায়ু অপেক্ষা শ্রীঘ্রগামী। সেদিন তার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন প্রশ্নকর্তা ধর্ম। আসলেই তাই, মানুষের মনই সবচেয়ে বিচিত্র ও দ্রুতগামী। সে কারণেই ভালোবাসা বদলায়। চিরকাল এক মানুষকে ভালোবাসতে চাইলেও, ভালোবাসা হয়ে উঠে না মানুষের।
প্রচলিত দাম্পত্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গাটি হচ্ছে ‘প্রোপার্টি কনসেপ্ট’। স্বামী বা স্ত্রী একে অপরকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে ভাবে। ইচ্ছের মূল্য নেই, স্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতা নেই জীবনযাপনেরও। মেয়েরা ভাবে স্বামীটি কেবল আমার। পুরুষেরা ভাবে স্ত্রী আমার নিজস্ব সম্পত্তি। অথচ একজন ব্যক্তি তার শৈশব থেকে বিয়ে পর্যন্ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কত না স্বজন, আত্মীয়, বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়ায়। ফলে এককভাবে স্বামী বা স্ত্রীকে ‘নিজস্ব সম্পত্তি’র ধারণা টানাপোড়েন অনিবার্য করে তোলে। এমনকি বিয়ের পর আর কাউকে ভালো লাগতে পারবে না, আর কারো প্রতি ভালোলাগা তৈরি হতে পারবে না- এটিও স্বাভাবিক নয়। কারণ, ভালোলাগা বা ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার, বলে কয়ে, ঘোষণা দিয়ে, কারো জীবনে তা আসে না। সবচেয়ে বড় বিষয় বিশ্বাস। বন্ধুত্ব বা দাম্পত্য যে সম্পর্কই হোক না কেন, একবার তাতে ফাটল দেখা দিলে, চিড় ধরলে অন্য কোন কিছুই তা রোধ করতে পারে না, চূড়ান্ত ভাঙনের আগে।
গত কদিন ধরেই তাহসান-মিথিলার বিচ্ছেদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়। নানাজনের নানা মন্তব্য। কোন কোনটি অশ্লীলও বটে। যে কোন কারণে বা কোন কারণ ছাড়াই যেমন সম্পর্ক, প্রেম গড়ে উঠতে পারে; তেমনি কোন কারণ বা কারণ ছাড়াই তা ভাঙতেও পারে। এই ভাঙাগড়া ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত। কখনও কখনও ব্যক্তি নিজেও জানেন না, এমন কেন হয় মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড তা-ই বলেছেন। ফলে তাহসান ও মিথিলা যদি স্বেচ্ছায় কোন সিদ্ধান্ত নেয়, তা নিয়ে অত মাতামাতি, তোলপাড়ের কী আছে অন্যদের?
আমি তো মনে করি তাহসান ও মিথিলার সততা ও সাহস অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। এখানে প্রায় তারকাই নিজের বিয়ে, ডিভোর্স এসব লুকোয় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ চিন্তা করে। সে কারণেই হয়তো ওমর সানির আগে আরো দুটি বিয়ে করেও মৌসুমী তা গোপন করেন, যা পরবর্তী সময়ে আব্দুর রহমান সম্পাদিত প্রিয়জন পত্রিকায় কাবিননামাসহ প্রকাশিত, শাবনূর অস্ট্রেলিয়ায় স্বামী সন্তানের কথা গোপন রাখেন, অপু-শাকিব গোপন রাখেন নয় বছরের দাম্পত্য। আমরাও হয়তো তারকাদের কাছ থেকে এমন আচরণ পেতে পেতে মিথ্যার প্রতিই আস্থাশীল হয়ে উঠেছি।
আসলে বাইরে থেকে অন্যের জীবন বোঝা যায় না, কখনও কখনও নিজের জীবন নিজেও বোঝে না মানুষ, বোঝা যায় না- এটাই জীবনের নিয়তি। যার যার জীবনের সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে দিন। কেননা, জীবনটা তার একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত। তাই কোন অমূলক মন্তব্য না করে আসুন ‘চুপ’ থাকি।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/আরআইপি