ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্কুটার চালক, অধ্যাপনা ও আমলা সমাচার

প্রকাশিত: ০৬:৪৯ এএম, ২৬ মে ২০১৫

আমলা হতে হলে অবশ্যই মেধা থাকতে হবে। তাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কয়েকটি ধাপ পার হয়েই সরকারি চাকুরিতে ঢুকতে হয়। তাকে কিন্তু প্রথম  শ্রেণিতে প্রথম হতে হয় না, অথবা প্রথম  শ্রেণি না পেলেও আমলা হওয়া যায়।  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রথম  শ্রেণিতে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীটি শিক্ষকতার পেশাটিই বেছে  নেন। প্রথমস্থান অধিকারী না হয়েও মেধা তালিকার প্রথম দিকের ছেলে-মেয়েরাই শিক্ষকতায় যুক্ত হন। প্রথম   শ্রেণি না পেলে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগই পান না। অর্থাৎ দেশের সবচে মেধাবী অংশটি শিক্ষকতায় যুক্ত হচ্ছেন। এই দুটি পেশার অধিকারীদের মধ্যে বেতনের যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে  মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।


একটা সময় ছিল যখন মেধাবী ছাত্রটি সরকারি চাকুরি বেছে নিতেন। সেটা অবশ্য পাকিস্তান বা বৃটিশ আমলের কথা।  বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষকতা  ছেড়ে অনেকেই তখন সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়ে জাঁদরেল আমলা বা জাঁদরেল বিচারপতি হয়েছিলেন। সেই আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির বদল হয়েছে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে তাকে সবচেয়ে ভালো ফলাফলের অধিকারী হতে হয়। তবে চাকুরির বাজারে সরকারি চাকুরির চেয়ে প্রথম সারির মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতাটাকে বেছে নেন। কিন্তু  পেশাগত জীবনে তাদের এই মেধার কোনো বাড়তি পাওনা নেই।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সম্প্রতি যে অভিযোগ করেছে সরকারের উচিত তা বিবেচনায়  নেওয়া। সমিতি বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের প্রস্তাবিত  বেতনকাঠামোয় শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ  করার মতো প্রস্তাব রেখেছেন। সচিব কমিটি আরও একধাপ এগিয়ে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে অন্যদের জন্য বৈষম্যের ব্যবস্থা করেছে। সপ্তম জাতীয় বেতনকাঠামোতে শিক্ষকদের যে অবস্থান ছিল, প্রস্তাবিত  বেতনকাঠামোয় তা দুই ধাপ নামিয়ে আনা হয়েছে।


কমিশনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় যত দিন স্বাবলম্বী না হবে, তত দিন স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করা যুক্তিযুক্ত হবে না। অথচ ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও আলাদা  বেতন স্কেল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি  দেয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজের পায়ে দাঁড়াবে কিভাবে? স্বাবলম্বী হতে হলে শিক্ষার্থীদের বেতন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ হারে নির্ধারণ করতে হবে। আর তাই যদি করা হয় দরিদ্র অভিভাবকদের মেধাবী সন্তানের জায়গা কোথায় হবে?


ফরাসউদ্দিন কমিশন ১৬টি গ্রেডে বেতন কাঠামো প্রস্তাব করলেও সচিব কমিটি আগের মতো ২০টি  গ্রেড রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করে দিয়ে মূলত পদোন্নতির মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে ওঠার সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষকরা প্রশ্ন রেখেছেন সচিব কমিটির সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো সপ্তম বেতন কাঠামোর অনুরূপ না হয়ে সেখানে সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিবের মতো বিশেষ ধাপ কেন করা হলো? বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকরা সচিবদের সমান  বেতন-ভাতা পান। কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক তথা সিলেকশন গ্রেড পাওয়া অধ্যাপকদের অবস্থান দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দিয়ে অপমান কেন করা হলো?


বিসিএস দিয়ে একজন ছাত্র আমলা হওয়ার কয়েক বছর পর ইউএনও বা মাঠ পর্যায়ে পোস্টিং  পেলে গাড়ি হাঁকিয়ে চলাফেরা করেন। সরকার তাকে কাজের সুবিধার জন্য গাড়িটি দিচ্ছে। আর পদোন্নতি  পেয়ে উপসচিব হয়ে  জেলা প্রশাসক হলে  তো কোনো কথাই নেই, সুযোগ সুবিধার অভাব নেই। আর একটা পদোন্নতি অর্থাৎ যুগ্ম সচিব হলে পোস্টিঙের দরকার পড়ে না, তিনি গাড়ি বাড়ি পেয়ে যান। পাশপাশি একজন শিক্ষক সারা জীবন শিক্ষকতা করে এরূপ সুযোগ সুবিধা পান না। ভাবতে অবাক লাগে ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক গাড়ি সুবিধা পান না! আর বেতন ভাতার কথা যদি বলি সেটা রীতিমত হাস্যকর। সারাজীবন পড়াশোনা করে, বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে শিক্ষকতায় থেকে সংসার চালানোর জন্য যদি রাতদিন চিন্তায় থাকতে হয় তারা ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা করবেন কখন।


আর গবেষণাই বা করবেন কিভাবে? এমনকি এই  দেশেরই কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো  প্রভাষক অর্থাৎ চাকুরিতে  যোগ দিয়েই  যে  বেতন পান,  সেই সমপরিমাণ  বেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও পান না।
আর তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের  দেখা যায় অর্থের সংস্থানের জন্য  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন,  কেউ  কেউ  বেসরকারি সংস্থায় কনসালটেন্সি করছেন,  কেউ বা লিয়েন নিয়ে অন্য চাকুরি করছেন,  কেউ  কেউ বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়ে ফিরে আসছেন না। আর যারা কোথাও কিছু করছেন না বা করতে পারছেন না তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসার জন্য বা বাড়তি  কোনো দায়িত্ব পালনের জন্য গবেষণায় সময় না দিয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে উত্তম মনে করছেন।


বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায় ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টিতে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় হয়নি। ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২টির কোনো গবেষণা প্রকল্পই  নেই! ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দই  নেই। আবার যতোটুকু বরাদ্দ আছে তা না থাকারই সমান। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ তিন  কোটি ১০ লাখ টাকা যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ১ শতাংশেরও কম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৯শ` শিক্ষক ও ২২ হাজার শিক্ষার্থীর গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৯ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ১ ভাগেরও কম।  প্রতি শিক্ষকের ভাগ্যে গবেষণার জন্য বছরে  জোটে মাত্র ১১০০ টাকা! ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট ১৬৫  কোটি ৬৫ লাখ টাকা বাজেটের মধ্যে গবেষণা খাতে ব্যয় হয় নয় লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের  মোট বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৫৬ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭টি গবেষণা প্রকল্প চললেও বাজেটে গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়নি।


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার এই চিত্র শুধু রাজনৈতিক  লেজুড়বৃত্তিতে সময় দেওয়া বা রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ  দেওয়া বা  নৈতিকতার অবক্ষয়েরই কারণ নয়। একটি রাষ্ট্রের চিন্তা চেতনারও প্রকাশ এতে ঘটেছে। শিক্ষকদের সবাই নিশ্চয়ই রাজনীতি করেন না, এতো সীমাবদ্ধতার মাঝেও অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা প্রকৃত অর্থেই একটি সুন্দর জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে চান। কিন্তু তাদেও সেই সুযোগ নেই। কারণ সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষকের আয়  যে একজন স্কুটার চালকের চেয়েও কম এটা নিশ্চয়ই কারো বিশ্বাস হবে না। যদিও এটাই সত্যি। সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হয়েও যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তিনি ২০-২০ হাজার টাকার  বেশি আয় করেন না, একজন স্কুটার চালক প্রতিদিন ৮০০  থেকে ১০০০ টাকা বাড়ি নিয়ে  যেতে পারেন। তার মানে একেবারে পড়াশোনা না করা  একজন ব্যক্তি সারাজীবন পড়াশোনা করা ব্যক্তির  চেয়ে ভালো আয় করেন। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন  দেশে এই চিত্রটা উল্টো। অন্যান্য  দেশে শিক্ষকদের শুধু শিক্ষকতা নিয়ে, তার গবেষণা নিয়েই ভাবতে হয়, রুটিরুজির দায়িত্ব কর্তৃপক্ষই নিয়ে  নেয়।


আর এ  দেশে শিক্ষকতা সচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তাতো দিচ্ছেই না, সামাজিক মর্যাদাও দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। নতুনরা আসতেই চাইবে না আর পুরানোরা যারা শিক্ষকতা  বেছে নিয়েছেন তাদের মাঝেও হতাশা বাড়ছে।  দেশকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার শিখরে নিয়ে  যেতে হলে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। আসছে জাতীয় বাজেটে সরকারকে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সরকারকে ভাবতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের  সেরা শিক্ষার্থীটি শিক্ষকতাকে  বেছে নিবেন, না স্কুটার চালক হওয়া লাভবান মনে করবেন।



এইচআর/এমএস