ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

টেকসই রূপান্তর

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ০৩:৪৫ এএম, ২০ জুলাই ২০১৭

না চাইলেও এক বৈশ্বিক দৌড়ের ট্র্যাকে পড়ে গেছি আমি এবং আমরা। আমাদেরকে টেকসই হতে হবে। টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত হতে হবে। ‘চকচক করিলেই সোনা হয় না’, এই আপ্তবাক্যটি এখন এরকম হয়ে গেছে- ‘টেকসই না হইলে উন্নয়ন উন্নয়ন হয় না।’

একটা বয়সের পর মানুষ আর শেখে না। আসলে শিখতে পারে না। আর তাই কাদামাটির মতো গড়ে তোলা যায় যে শিশুদের, তাদেরকে শেখানোর জন্য আমরা দিন-রাত মাথা কুটে মরি। শিশুরা কী চটপট শিখে নেয়! আমাদের মুখের কথা শুনে শেখে, আমাদেরকে দেখে শেখে আরও বেশি। এই শিশুরা আমার এবং আমাদের মুখে শুনেছে, মিথ্যে বলা মহাপাপ। শুনেছে, গুরুজনকে ভক্তি কর।

শিশুরা মিথ্যে বলে না, যদি না সে বড়দেরকে মিথ্যে বলতে দেখে ব্যাপারটা শিখে নেয়। শিশুরা ভালোবাসার জন্মগত ক্ষমতা নিয়েই পৃথিবীতে আসে, তারপর বড়দের ভালোবাসাহীনতা দেখে নিজেই হয়ে যায় ইরেজার। ভালোবাসা মুছতে শুরু করে। এই শিশুরা এখন বুঝে নিচ্ছে, গুরুজনরা এতকাল নিজেদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর সম্পদ এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে শিশুদের জীবন চালানোর রসদটুকুও প্রায় ফুরিয়ে আসছে, আরাম তো পরের কথা। এই গুরুজনদের ভক্তি করতে শেখালেও কি শিখবে ওরা? শিখবে না। শিখছে না। আর তাই জি২০ সম্মেলনে ক্ষুব্ধ তারুণ্য  স্লোগানে আগুন মিশিয়ে ছুঁড়ে মারছে বুকের ঘৃণা। বলছে, জাহান্নামে স্বাগতম, হে জি২০!

বিশ্বের ক্ষমতাধর ২০ দেশের নেতৃবৃন্দ গোটা বিশ্বকে জাহান্নামে পরিণত করার দায় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও এই দায় তাদের গুরুজন অর্থাৎ পূর্বসূরিদেরও। সমৃদ্ধির সীমারেখা যারা মাপতে পারেননি বা চাননি। যুদ্ধ-বিগ্রহ-ই যাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানুষের কর্তব্যের চেয়ে। পেশির জোর দেখিয়ে সুপার পাওয়ার হতে বা ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে যারা দেশ-বিদেশে ইচ্ছেমত গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়েছে, ক্ষমতার ঘুঁটি উল্টে দিয়েছে, তুচ্ছ করেছে মানুষের সত্যিকারের শক্তিকে।

গত ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী চলমান মন্দার সময়ই এই প্রশ্নগুলো জোর গলায় আলোচিত হতে শুরু করেছিল। এই যে সম্পদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, এর জন্য কে দায়ী? যে দায়ী সে দায় নেবে না কেন? সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়া ঠেকাতে এক্ষুণি সম্পদের ব্যবহার ঠেকালে কী ঘটবে? পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে টেকসই উন্নয়নের যে কথা বলে হচ্ছে, তা কীভাবে শুরু করা সম্ভব হবে? কে করবে সেই শুরুটা? গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলা অপরিণামদর্শী বিশ্ব কীভাবে টেকসই পরিবর্তনে রূপান্তরিত হবে? সম্পদের সুষম বন্টন কীভাবে সম্ভব? অভাব সবার জন্য একই রকম নয় বলেই অভাব দূর করার বৈশ্বিক মাপকাঠি কি হতে পারে? 

শ্রেণি-লিঙ্গ পরিচয়-বয়স-জাতিগত পরিচয়-ভূতাত্ত্বিক অবস্থান অভাবের ব্যাখ্যা এক রকমের দেবে না, ঠিক সেভাবেই টেকসই উন্নয়নের রূপরেখাও সবার জন্য সমান নয়। টিমোথি মিচেল বলেছেন, সম্পদ আর রাজনীতি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তের সম্পর্কে আবদ্ধ, আর তা-ই রাজনৈতিক অর্থনীতি। সুপেয় পানির উদাহরণ টেনে লায়লা মেহতা যুক্তি দিয়েছেন, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে নানান বহিঃস্থ বিনিয়োগকারী, রাষ্ট্র, সামরিক-বেসামরিক গ্রুপ আর স্থানীয় জনগণের ভেতর দ্বন্দ্ব দিনকে দিন জোরালো হয়ে উঠছে। 

মানবাধিকার, নারীর অধিকার, ভূমিপ্রশাসনের দক্ষতা আর অবশ্যই রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এই দ্বন্দ্বে রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণকে সর্বনিন্ম মাত্রায় নামিয়ে আনতেও আরেক ধরনের রাজনীতির জন্ম হয়েছে, যা মহাদেশের সীমানা থেকে দেশ-সমাজ এমনকি ব্যক্তির সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আপনার বাড়ির বৈদ্যুতিক বাতি অপ্রয়োজনে জ্বালিয়ে রাখবেন না, এই আহ্বান আর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্যারিস চুক্তিতে সম্মতি জানানোর আহ্বানের মাঝে পার্থক্য নেই মোটেও। এমনি কঠিন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, দাঁড় করিয়েছেন আমাদের গুরুজনেরা। আর তাই আমাকেও জানতে হচ্ছে টেকসই হতে হলে কীভাবে হব? কীভাবে আমার টেকসই রূপান্তর সম্ভব হবে?

প্রযুক্তিগত রূপান্তর হতে পারে, এটা হচ্ছে প্রথম পন্থা। বৃটেনে রূপান্তরশীল শহর আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যেখানে কার্বন নিঃসরণমুক্ত প্রযুক্তি আর এর সাথে সম্পর্কিত স্থাপত্য নকশায় টেকসই শহর গড়ে উঠবে বলে বলছেন আন্দোলনকারীরা। বিকল্প জীবনযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে শহরবাসীকে, যারা সবুজ পৃথিবীর কথা ভেবে নিজস্ব গাড়ি নেই বলে তৃপ্তি বোধ করেন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা পায়ে হেঁটে অফিস যাচ্ছেন, এমন খবর পড়ে বিষয়টাকে ব্যক্তিগত ঔদার্য্য ভেবে বাহবা দিলেও এই ব্যবহার আমার কাছ থেকেও পৃথিবী আশা করছে কি না, ভাবি না। ভাবতে হবে। সূর্যের আলোয় আপনাতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, এমন কাপড় আবিষ্কার করতে মরিয়া বিজ্ঞানীরা, কেননা তাতে পানির খরচ কম হবে। পানির কম ব্যবহার করা উচিত ভেবে বহু মানুষ মাংস পরিহার করে শাকাহারী হয়ে উঠছেন। রূপান্তরিত হতে হবে আমাকে। আমাদেরকে।

বাজারভিত্তিক রূপান্তর আরেকটি নতুন ধারণা। গোটা বিশ্ব একটি বাজার, যেখানে আমার চাহিদার সাথে নরওয়েবাসী কারোর সরবরাহকে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমি বলতে পারি টাটা-বিড়লাকে, ইন্ড্রাস্ট্রি বসিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি করেছ, তার বিনিময় মূল্য হিসেবে আমার বাড়িতে পরিবেশের উপকারার্থে সৌর প্যানেল বসিয়ে দাও, যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে আমি তোমার করা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিবেশকে সাহায্য করতে পারি। কার্বন সমতা সৃষ্টি করা সম্ভব এভাবে, যাতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ না বাড়ে। ক্রমশঃ এভাবেই গড়ে উঠছে সবুজ একাউন্ট, সবুজ অর্থনীতি, সবুজ বাজার, সবুজ বাণিজ্য। এই বাজারে কে জিতবে, কে হারবে তার হিসেব করতে গেলে হেরে যাবে পৃথিবী নিজেই। পৃথিবীকে জিতিয়ে দিতে সব আমার হলেই আমি জিতব, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে কিন্তু।

মানুষের মতো এই জয়-পরাজয়ের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেও। কেননা, রূপান্তর রাষ্ট্রভিত্তিকও হতে হবে। রূপান্তরের টেকসই রাজনীতির মূল কর্ণধার তো রাষ্ট্রই। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই রাষ্ট্র হিসেবে সবুজ উন্নয়ন সম্ভব করে তুলছে। ফটোভোল্টেইক প্রযুক্তিতে চীন এখন এক নম্বর। ডেনমার্কের বায়ুশক্তি বিশ্ব বাজারে ইতোমধ্যে প্রভাব গড়ে তুলেছে। জার্মানি এর পারমাণবিক সক্ষমতাকে নবায়ণযোগ্য শক্তি উৎপাদনে সরকারের সহায়তায় ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগের যে পরিমাণ দাঁড় করিয়েছে, তা বিপুল। বাংলাদেশ বাসাবাড়িতে সৌর প্যানেল স্থাপনে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকারকারী দেশ। এভাবেই রাষ্ট্র আর বাজার পরস্পরের সহযোগী হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র যতবেশি স্বনির্ভর, বিদেশি সাহায্যমুক্ত, এর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তত বেশি। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয় তত্ত্ব দিয়ে আমেরিকা-ইউরোপ গণতন্ত্রের যে রূপরেখা দিয়ে অন্য দেশগুলোকে চাপে রাখে, ইথিওপিয়া আর রুয়ান্ডার মতো আফ্রিকার দু’টি গণতন্ত্রহীন দরিদ্র দেশে রাষ্ট্রের উদ্যোগে সবুজ অর্থনীতি আর টেকসই উন্নয়নের অগ্রগতির সাফল্য ঐ গণতন্ত্র-তত্ত্বের গালে চপোটাঘাত করতে শুরু করেছে।

সব প্রশ্নের উত্তরে মনের ভেতরকার মন বলে উঠছে, মানুষকে আসলে ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা, রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের নাগরিক তো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত। ভারতে নিরাপদ টয়লেট ব্যবহারের ডাক রাষ্ট্র দিয়েছে, সফল করতে হবে ব্যক্তি নাগরিকের উদ্যোগেই। সরকার আর এনজিও কাজ করবে এক সাথে, ব্যক্তিও থাকবে না দূরে। ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ কেবল আদালতে মিলতে হবে, তা নয়। মানুষের প্রতি মানুষের বৈষম্য কখনোই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব করবে না, এটা বুঝতে হবে ঘরের বউ, পরের মেয়ে, কাজের মেয়ে, রিক্সাওয়ালা ইত্যাকার চিহ্ন সরিয়ে মানুষের স্বার্থে মানুষকে জাগিয়ে তুলে। পরিবেশ রক্ষার কাজে বিজ্ঞানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে স্থানীয় জ্ঞানকে অবহেলা করা চলবে না। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব সফল করেছিল কারা? মনে রাখতে হবে সব।

বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠছে ব্যক্তি। রাষ্ট্রের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে, জি২০ মার্কা সম্মেলনের আশায় বসে না থেকে ব্যক্তি নিজেই ঠিক করে নিচ্ছে নিজের ভূমিকা। এর ফলে রূপান্তরের প্রযুক্তিগত-বাজারগত-রাষ্ট্রগত-ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া প্রায়শঃ একে অপরকে স্পর্শ করছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে কেউ কারোর থেকে আলাদা নয়। এই চার রূপান্তরের মিলিত ক্ষেত্রে জেগে উঠেছে সত্য-নিয়ম আর সম্মেলন শক্তির প্রয়োজনীয়তা। সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না, এ সত্য এখন মানতেই হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এই সত্য প্রতিষ্ঠার নামান্তর, যা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এর জন্য নিয়ম সবার জন্য সমান, এমন ব্যবস্থার নিশ্চিতিকরণ হতেই হবে। 

সম্মেলন শক্তির কথা বলি সব শেষে। এই পৃথিবী আমার একার নয়, আমি এবং আমরা সবাই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে এসেছি। গায়ের রং-জাতিগত পরিচয়-ভূতাত্ত্বিক অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতি না করে মানুষকে সম্মিলত হতে হবে, থাকতে হবে সব সময়। তবেই রাজনীতি হবে সবুজ, থাকবে সবুজ। নইলে ভরসা কি রাজনীতির, এর ভেতরেই যে নিহিত আছে এর সর্বনাশের বীজ!

জয় হোক মানুষের। তবেই যে জয় হবে পৃথিবীর!   

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, নাট্যকার। 

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন