ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একজন আরমান হোসেন ও নির্যাতিত শিশুর আর্তনাদ

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৪:২০ এএম, ১৯ জুলাই ২০১৭

গণমাধ্যমে একজন পিশাচের চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। আরমান হোসেন নামের এই পিশাচ গত আট বছর ধরে নিজের সৎকন্যাকে ধর্ষণ করে চলেছে। অসহায় মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে নির্মমভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এমনকি খালার বাড়িতে পালিয়ে গিয়েও রেহাই পায়নি সে। শুধু মেয়েটিকে ধর্ষণই নয় তার আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে তাকে ৮ বছর ধরে নির্যাতন চালানো হয়। মেয়েটির বয়স বর্তমানে ২০ বছর। ভিকটিম মেয়েটি নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছে। কতখানি অসহায় হলে একটি সদ্যতরুণী মেয়ে নিজে থানায় গিয়ে এ ধরনের অভিযোগ করতে বাধ্য হয় তা কল্পনা করে শিউড়ে উঠতে হয়।

সৎপিতা দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা এই প্রথম নয়। চলতি বছরেই এমন আরও কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মে মাসের ১১ তারিখে রাজধানীর উত্তরখানে ঘটেছে এমনি নারকীয় ঘটনা। আয়নুল নামে এক পিশাচ সৎবাবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে নয় বছরের এক শিশু। এর আগে খাগড়াছড়ি ও শালবনগ্রামে একই ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটেছে।  ১৪ মে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে ভারতের হরিয়ানায় সৎ পিতার ধর্ষণের কারণে গর্ভবতী হয় ১০ বছরের এক শিশু। পরে হাসপাতালে তার গর্ভপাত করার অনুমতি মেলে। সবচেযে জঘন্য ঘটনাটি ঘটেছে দিল্লিতে। ৬ বছরের একটি শিশু সৎপিতার ধর্ষণের শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার উপর ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছে। মেয়েটি এতটাই গুরুতর আহত হয় যে সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যায়।  

একটি মেয়ে সবচেয়ে নিরাপদ তার পিতার কাছে। বাবার মধ্যে সে দেখে তার আদর্শকে। ‘বাবা’ শব্দটি সন্তানের জীবনে পবিত্র সম্পর্ককে প্রকাশ করে। নাহয় জন্মদাতা নাই হলো। তবু  সৎপিতাও তো ‘পিতা’ নামটি নিয়েই তার জীবনে আসে। সৎপিতার কাছ থেকেও তো স্নেহ, মমতা ও নিরাপত্তা আশা করে সন্তান। অথচ সেই পবিত্র নামটি ধারণ করে যখন এক নরপিশাচের আবির্ভাব ঘটে তখন মেয়েটির অসহায়তা কল্পনাও করা যায় না। বেশিরভাগ সময় মেয়েটির মাও পড়েন চরম অসহায় অবস্থায়। কারণ সন্তানের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে তাকে ছাড়তে হবে দ্বিতীয় স্বামীর ঘর।

আমাদের সমাজে নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে এমনিতেই কোন নারীর দ্বিতীয় বিয়েকে সুনজরে দেখা হয় না। মনে করা হয় নারী যদি সন্তানের মা হয় তাহলে তার আর দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজন নেই। বরং নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন বঞ্চিত জীবনযাপন করবে সেই নারী। সামাজিক ও আর্থিক  নিরাপত্তার কারণেও যে একজন নারী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন সেই বাস্তবতাও ভুলে যাওয়া হয়। আর দ্বিতীয় স্বামীর সাথে যদি তার বনিবনা না হয় তাহলে তো আরও বিপদ। কারণ তখন শুনতে হবে ‘নতুন স্বামীর ঘরও করতে পারেনি’। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকেও নারী থাকে দুর্বলতর। তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় মেয়েটির মায়ের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। এই ঘটনা মেয়েটির মা জানতো বলেও প্রকাশ। যদি দেখা যায় এ ব্যাপারে সন্তানের  মঙ্গলের দিকটি না দেখে অপরাধী স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে মা তাহলে তাকেও নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এসব ক্ষেত্রে যত অসহায় অবস্থানেই মা থাকুন না কেন, সন্তানকে বাঁচানোর জন্য তার উচিত  স্বামীর শাস্তি দাবি করা। প্রয়োজনে এসব ঘটনায় তাকে যদি স্বামীর ঘর ত্যাগ করতে হয় তো তাই করা বাঞ্ছনীয়। কারণ যে ধর্ষক সে চরম অপরাধী। একজন গুরুতর অপরাধীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখার তো কোন যুক্তি নেই। বিশেষ করে যে অপরাধটি ঘটছে তার নিজের সন্তানের সঙ্গে। প্রতিটি মায়ের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য তার নিজের সন্তানের প্রতি। তারপর অন্য যা কিছু।

সৎপিতার নির্যাতনের চিত্র সাহিত্যে তুলে ধরেন নবোকভ তার ‘লোলিটা’ উপন্যাসে। সেখানে মানসিকভাবে বিকৃত হামবার্ট নামে এক মধ্যবয়স্ক  ব্যক্তির জবানীতে সৎকন্যার প্রতি নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হামবার্ট তার সৎকন্যা কিশোরী ডলোরেসকে যৌনসামগ্রীর মতো ব্যবহার করে। তাকে ধর্ষণ করে। সে ডলোরেসের নতুন নাম দেয় ‘লোলিটা’। এই নামের মাধ্যমে ডলোরেস নামে একজন শিশুর মানবিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাকে যৌনপণ্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

নবোকভ যদিও হামবার্টের মানসিক সমস্যার দিকটিই উপন্যাসে তুলে ধরেন। অনেক সময় সেখানে ডলোরেসের নিপীড়িত চেহারাটি খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কান পাতলে সচেতন পাঠক ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবেন লোলিটা নামের আড়ালে মাতৃহীন ও পিতৃহীন অসহায় অনাথ শিশু ডলোরেসের আর্তনাদ। যার শৈশবের সমস্ত আনন্দকে হত্যা করা হয়েছে। পিতার স্নেহ মমতার পরিবর্তে যে নির্যাতন পেয়েছে বিপিতার কাছ থেকে। যার মানবিক সত্তাকে হত্যা করে তাকে পরিণত করা হয়েছে যৌনবস্ততে, যার উপর করা হয়েছে চরম অন্যায়।

সমাজে ভদ্রমানুষের মুখোশধারী হামবার্টদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তাদের হাত থেকে রক্ষা  করা দরকার ডলোরেসদের। এ ব্যাপারে সামাজিক সংস্থাগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকায় সমাজসেবামূলক সংস্থা থেকে প্রতিটি পরিবারে নিয়মিত নজরদারীর ব্যবস্থা আছে। যদি দেখা যায় বাবা-মা বা অভিভাবক কোন শিশুর অধিকার খর্ব করছে বা তাকে কোনপ্রকার শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করছে তাহলে রাষ্ট্র ওই শিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করে। নির্যাতনকারী বাবা-মা-অভিভাবকের কাছ থেকে শিশুকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের দেশেও এই নিয়ম থাকা দরকার। শিশুর স্বার্থ দেথতে হবে সবার আগে কারণ জাতির ভবিষ্যত তো শিশুরাই।

সাম্প্রতিক ঘটনায় আরমান নামের নরপিশাচটির কঠোর শাস্তি দাবি করছি। এ ধরনের ঘৃণিত নরপিশাচদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দরকার।  শুধু আরমান নয়, সকল শিশু ও নারী নির্যাতনকারী ও ধর্ষকদেরও কঠোর শাস্তি দাবি করছি।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন