আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা : বাকস্বাধীনতার শত্রু
ঔপনিবেশিক আইন, বিচারব্যবস্থার ত্রুটি, রাজনীতির দাপট এবং পুলিশের আচরণ। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা যারা করেন এবং যারা নানা স্তরে মত প্রকাশের লড়াইয়ে আছেন, তাদের সবসময় তাড়া করে এই চারটি বিষয়। আমি আমার কথা বলব, আপনি আপনার কথা বলবেন, সে তার কথা বলবে। এই অধিকার গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। অস্বীকার কেউ করবে না যে, সব অধিকারেরই স্বাভাবিক সীমা থাকে। এই অধিকারেরও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন করতে নানা রকমের তৎপরতা ক্রমশই ভয়ানক আকার ধারণ করছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ঠিক তেমনই এক ধারা যা চিন্তা প্রকাশের পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে।
গত বিএনপি সরকার আইনটি করেছে, আর এই সরকার একে আরো শক্তপোক্ত করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে এই আইন যতটা না প্রয়োগ হচ্ছে, যতটা না অন্যায়অবিচার রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থে। এবং কারা করছে? যেসব সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আছে, কিংবা যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লাগামহীন দুর্নীতি বা লোক ঠকানোর ব্যবসা করছে, তারাই বেশি আগ্রহী এই ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে মত প্রকাশকে হয়রানি করতে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগের বলি হচ্ছেন লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বিরুদ্ধেই এই আইনের প্রয়োগ বেশি। অথচ সামাজিক মাধ্যমে, অনলাইনে দিনরাত যারা দেশ বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত, তারা অবলীলায় এসব করছে। দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক মহল এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর কোন তৎপরতা নেই তাদের বেলায়।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রের শর্ত এই যে, একজন নাগরিক তার স্বাধীন চিন্তা বা মত প্রকাশ করবার অধিকার রাখে। গণতন্ত্র নাগরিককে তার মত অনুযায়ী চলবার অধিকার দেয় যতক্ষণ না তিনি সরাসরি কোন মানুষের, সম্প্রদায়ের বা রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি করছেন। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদের অধিকার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত এবং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। স্বাধীন মত প্রকাশ করার অর্থই কোন দেশবিরোধী কাজে জড়িয়ে যাওয়া নয়। সরকারের মত পছন্দ না হলে প্রতিবাদের অধিকার সাধারণ মানুষের আছে এবং সেই প্রতিবাদ জরুরি, কারণ তা সরকারকে ঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন শক্তিশালী। মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। এমন বাস্তবতায় কণ্ঠরোধের এক অস্ত্র হয়ে উঠেছে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। অনলাইনে কোন কথা বলা হলেই ৫৭ ধারা প্রয়োগ হচ্ছে। অন্য যেকোন মামলার চেয়ে এই মামলায় পুলিশের সক্রিয়তাও অনেক বেশি। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে এই ধারার সুযোগ মূলত নিচ্ছে নানা স্তরের অপরাধীরা। এদের একটা অংশই ক্ষমতাসীন কোন কোন মহলে ভাবমূর্তি বিষয়ক ধারণা পাকাপোক্ত করছে নিজেদের অনিয়ম আর দুর্নীতিকে লাগামহীন করতে।
খোদ রাজধানীতেই বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে হয়রানি করা হয়েছে। রাজধানীর বাইরে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাঙামাটি জেলা শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক চায়না পাটোয়ারী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা শাওন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এক কর্মী। এই মামলায় চায়নাকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণ হলো, তারা রাঙামাটির লংগদুতে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ করে ইন্টারনেটে লেখালেখি করেছেন। যে ভয়াবহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়েছেন, তার কোনও প্রতিবিধান না করে উল্টো প্রতিবাদকারীদেরই গ্রেফতার করা হলো। এখানে সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের কতটুকু লাভ হয়েছে জানিনা, তবে এই ধারা যে ক্রমেই দুর্বিনীতদের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, সুস্থতাকে বিনষ্ট করতে তা প্রমাণিত হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এই আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এটা কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। এটা মানবাধিকারবিরোধী নয়। এর অর্থ হলো এই আইনকে যে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা তথ্যমন্ত্রী মানতে নারাজ। তিনি আরো বলেছেন, ‘ডিজিটাইলেজশনের ফলে গণমাধ্যমের বিশাল প্রসার ঘটেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ডিজিটাল স্পেস তৈরি হয়েছে। এর ফলে অনেকে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়, চরিত্র হনন করে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির মতো অপরাধ করে’। কিন্তু সরকার কি জবাব দেবে, সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আসলেই কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। নাসিরনগরের রসরাজ বা সিলেটের রাকেশদেরই অত্যাচার করা হয়েছে যাদের নামে ভুয়া আইডি খুলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘অনুভূতি’ আর ‘ভাবমূর্তি’র ব্যবসা যারা করছে, যারা সমাজে ধর্মীয় সহিংসতার পথ প্রশস্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই বরং ৫৭ ধারায় মামলার শিকার হচ্ছে শান্তিপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ।
দুর্নীতিবাজ, অনিয়মকারী আর কর্তব্যে অবহেলাকারীরা এই আইন প্রয়োগ করছে যখন তখন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনসহ চার জনের বিরুদ্ধে তথ্য-ধারায় ৫৭ প্রযুক্তি আইনের যে মামলা হয় তা ছিল এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয় এই ধরনের অভিযোগ প্রায় সব ফেসবুক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধেই করা সম্ভব। গত ২৮ জুন সাংবাদিক নাজমুল হোসেন ‘বিচারপতির লাল সিঁড়ি ও দেলোয়ারের ক্র্যাচ’ শিরোনামে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়। একজন সাংবাদিক হিসেবে শুধু নয়, নাগরিক হিসেবে বৈষম্যের এক জ্বলন্ত ঘটনা তিনি প্রকাশ করেছেন। নাজমুল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাই লেখার সঙ্গে ছবিও দিয়েছিলেন। কোথাও কোন অসত্য ছিলনা তবুও মামলা হয়েছে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা একটি নিপীড়নমূলক বিধান এবং ক্ষমতা অপপ্রয়োগের হাতিয়ার। ভয়ংকর দিক হলো, এই ধারায় মামলা হলে জামিন পায়না আভিযুক্ত। ফলে এই ধারায় যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই হয়রানি করার জন্য করা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী বহুবার বলেছেন এই বিধানটি থাকবে না। নিবর্তনমূলক আইন শেষ পর্যন্ত সরকারের রক্ষাকবচ হয় না, আশা করি নতুন ডিজিটাল আইনের বেলায় একথাটা মনে রাখবেন আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা।
মানুষ নিজের স্বাধীন চিন্তা এবং বিচারের স্বাভাবিক অধিকার বা সামর্থ্য অন্য কাউকে দিতে পারে না, কিংবা অন্য কাউকে তা দিতে তাকে বাধ্যও করা যায় না। যে সরকার মানুষের মন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, সে স্বভাবে দমনমূলক। তবে একটা প্রশ্ন উঠবেই: বাকস্বাধীনতার কি কিছু ন্যায্য সীমা আছে? না কি, মানুষকে যা খুশি বলার অধিকার দেওয়া উচিত? ‘হেট স্পিচ’ অর্থাৎ তীব্র, হিংস্র কথা বলার অধিকারও কি দিতে হবে?
এই প্রেক্ষাপট থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত, ব্যক্তির স্বাধীনতা, তথ্য পাওয়ার অধিকার, গোপনীয়তা রক্ষা এবং নানা ধরনের অপরাধ থেকে সুরক্ষার বিষয়গুলো ডিজিটাল নিরাপত্তার অংশ। ইন্টারনেট ব্যবহার করে নতুন নতুন উপায়ে প্রতারণা, অন্যকে হয়রানি এবং হুমকি দেওয়ার মতো অপরাধ অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উপদ্রব—উগ্রবাদী ভাবাদর্শের প্রচার, প্রসার, প্রশিক্ষণের নির্দেশিকা বিতরণ এবং গোপন যোগাযোগের বিষয়গুলো নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই।
তবুও গণতান্ত্রিক পরিসরে মানুষের মত প্রকাশের জায়গা সংকুচিত করার কোন উদ্যোগই কাম্য নয়। সাইবার অপরাধ এবং উগ্রবাদ মোকাবিলার সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়গুলোকে গুলিয়ে ফেলা হলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রকে ধারণ করবার জন্য স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, বিশেষ করে প্রতিবাদের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, ‘ধারণ’ করার মূল অর্থেই, প্রতিবাদের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের ধর্ম। আশা করি নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস