স্রোতের বিপরীতে গেলেই কি চাবুক
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সাগরে ভাসে মানুষ, আবার সে দেশের মানুষই শুনছে তার আয় বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। আমরা এও দেখছি অনেক উড়াল সেতু হচ্ছে, পদ্মাসেতুসহ অনেক প্রকল্প সরকারের হাতে। বিদ্যুতের ঝলকানি বড় শহর ছাড়িয়ে অনেক ছোট শহরকেও মোহনীয় করে তুলছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা অমিলও রয়েছে একই সঙ্গে। উন্নয়নের সঙ্গে সুশাসনের যে একটি সম্পর্ক আছে, তা যেন অনেকটাই অনুপস্থিত।
নিজে একটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি। নানা ধরনের রিপোর্ট করে আমার ছেলে-মেয়েরা। দু’একটা পত্রিকা পড়ি, অন্য টিভিও দেখি। কিন্তু সব পড়া হয় না। সব দেখা হয় না। এবার প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগে দুর্নীতি সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদনগুলো পড়ে আর দেখে মনে অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে। কোথায় চলেছি আমরা?
যারা প্রভাবশালী, যারা উপর মহলের লোক, তারা সব করছেন, কিন্তু কিছুই নিয়মের মধ্যে করছেন না। তাই আয়বৃদ্ধি আর সুখে থাকার গল্প যখন বলেন আমাদের ক্ষমতাসীনরা তা আমাদের উচ্ছ্বসিত করে না। মানুষের কুশলে থাকা, মেধানির্ভর সমাজ নির্মাণের পথে দুর্নীতি এক বড় বাধা। অন্যের টাকায় উপর মহলের রাজনীতিকরা, আমলারা, ব্যবসায়ীরা ফুলে ফেঁপে উঠছেন, অন্যদিকে তাদেরই কারণে, কিংবা তাদের উদাসীনতায় আমাদের মানুষেরা সাগরে ভাসতে ভাসতে মানব কংকাল হয়ে উঠছে।
সুবিধাবাদের রাজনীতি আছে অনেকদিন থেকেই। কিন্তু নতুন এক রাজনীতি দেখছি আমরা। এরা শুধু শাসক হওয়ার জন্যই রাজনীতিকে বেছে নিয়েছে। তাদের ঔদ্ধত্যে রাষ্ট্রও নীরব থাকে। তাই তারা ড. জাফর ইকবালকে চাবুকের হুমকি দেয়। এবং বিশ্বাস করি যে একটা সময় হয়তো আসবে, যখন হুমকি, সত্যিকারের চাবুকই মারা শুরু হবে।
আবার বর্ষবরণে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার প্রতিবাদে তারুণ্যের মিছিলে, পুলিশ কর্তৃক তরুণী নির্যাতন আরেক বার্তা দেয় যে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের দূরত্ব বাড়ছে, তাদের ক্ষোভের মুখে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। এ প্রজন্ম তাদের মা-বাবাদের তুলনায় অনেক সচেতন, বিশ্বায়িত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মতো অর্থলুলুপ বা সন্ত্রাসী নয়।
আবার যারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার গণ্ডিকে আরো ছড়িয়ে দিতে চান, তাদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে একদল ঘাতক। সিলেটে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ এদের সর্বশেষ শিকার। রাষ্ট্র এখানেও চরম অদক্ষ, যদিও নারীর উপর ঝাপিয়ে পড়তে তার দক্ষতার কমতি থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতাসীনরা ভুলে যায় যে, স্পর্ধিত প্রত্যয়ে নিজের স্বাধীনতা দাবি করা মানুষ সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে তখনই যখন সে দেখে সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও তার জন্য আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে ক্ষমতায় থাকা মানুষেরা। সামন্ত সংস্কৃতিকে পুঁজি করে ক্ষমতাসীন থাকা এসব রাজনীতিক মনে করেন সাধারণ মানুষ মাত্রই তাদের সামনে করজোড়ে, নতমস্তক হয়ে দাঁড়াবে। তাদের কথার সমালোচনা করবে, চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে এ বাস্তবকে বুঝতে না পারার জন্যই চাবুকের হুমকি দেন তারা।
কোনো নতুন ঘরানার রাজনীতি তার আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না, এটাই হলো সময়ের সবচেয়ে বাস্তব সত্য। কিন্তু এর মধ্যে থেকেই মানুষ নতুন কিছু করতে চায়। মানুষ নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চায়। আর এই মানুষেরা সরকারের কাছে সামান্যই প্রত্যাশা করে। তারা নিজেদের উন্নতি নিজেদের চেষ্টাতেই করবে। শুধু তাদের আশা, সরকার তাদের উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশটুকু তৈরি করে দেবেন, একটু শান্তি দেবেন। আগামী দিনে রাজনীতিকরা হয়তো এ ধরনের প্রত্যাশার মধ্যে একটা সাযুজ্য আনবেন সেটা আশা করতে চাই। এমন এক রাজনীতি চাই যে রাজনীতি দেশের তরুণ প্রজন্মের আধুনিকতার ইচ্ছাকে, প্রযুক্তি-নির্ভর স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে। এমন পথের খোঁজে কবে পথ হাঁটবে বাংলাদেশ আমরা জানি না। কিন্তু আশা করতে পারি। নিশ্চয়ই আজ যারা কণ্ঠ থামাতে চাবুক মারতে চান সেই সনাতনীরা পথ পাবে না, নতুন ভাবনার রাজনীতিকই আগামীর জয়গান গাইবেন। ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি কখন কোথা থেকে কোন অভিঘাতে পাল্টে যায়, পথভ্রষ্ট হয়, তা কি কেউ জানে?
এইচআর/এমএস/বিএ/এমএস