ঘরে ঘরে জীবনসংহারী মাদক ও আমাদের করণীয়
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের বাংলা ক্লাস নিতেন শ্রদ্ধেয় মকছেদ আলী স্যার। একদিন ক্লাসে মাদকাসক্তি নিয়ে আমাদের ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এক ছিলিমে যেমন তেমন, দু্ ছিলিমে মজা/তিন ছিলিমে উজির নাজির, চার ছিলিমে রাজা”। অর্থাৎ কিভাবে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে এবং নিজেকে সবার থেকে আলাদা বা একটু অন্য রকম করে ভাবতে গিয়ে কিশোর এবং তরুণেরা মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে-সেটা বুঝাতে গিয়ে স্যার উপরের মন্তব্য করেছিলেন। স্যার গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো।কিন্তু এখনও অতীতের অনকে স্মৃতির মাঝে স্যারের স্মৃতি যখন মনে পড়ে তখন অবধারিতভাবে স্যারের বলা উক্ত কথাগুলোও মনে পড়ে।
ধারণা করি, এখানে ছিলিম মানে টানা(এক ছিলিমে মানে এক টানে!)অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এক সময় গ্রামে-গঞ্জে গাঁজা্ ছিলো মাদকের প্রধান উৎস। দাম কম হওয়ার কারণে নানা বয়সী মানুষের কাছে তার চাহিদাও ছিলো বেশি। নব্ব্ই এর দশকের শুরুতে আমি যখন মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র তখন আমার পরিচিতমহলে গাঁজা সেবনকারী হিসেবে তেমন কাউকে দেখিনি।কিন্তু সময় অনেক পাল্টেছে। গ্রামে গেলে এখন তা বোঝা যায়।
আর নব্ব্ই দশকের শেষ (বিংশ শতাব্দীরও শেষ) এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দেখলাম ফেনসিডিল নামক মাদকের ভয়াবহ এবং অবাধ উপস্থিতি। যদিও মেডিকেল কলেজে পড়ার সুবাদে সেখানে এর সহজপ্রাপ্যতার কথা লোককাহিনীর উপকথার মতো লোকের মুখে মুখে ফিরতো।কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ফেনসিডিল তৈরি হয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে সহজেই আমাদের দেশে পৌঁছে যেত।আর সহজপ্রাপ্যতার কারণে (সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায়) তা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তরুণদের কাছে নেশার প্রধান বস্তু হয়ে ওঠে। এভাবে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ; যারা দেশকে হয়ত অনেক কিছু দিতে পারতো কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা মাদকের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়ে তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে ফেলে। সে নষ্ট সময়ের কথা মনে পড়লে কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না।
জানা যায়, ফেনসিডিলের আগমন মূলত শুরু হয়েছে আশির দশকের শেষভাগে। তারপর তা ব্যাপকমাত্রায় তরুণ যুবকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে নব্বই এর প্রথম ভাগে।তখন থেকেই পারিবারিক এবং সামাজিক নানা অশান্তি শুরু হতে থাকে।তার আগে নেশার কারণে পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ বা খুনোখুনি এতটা ভয়াবহ মাত্রায় ছিলো না। এর পেছনের কারণ অর্থ; মাদক কেনা-বেচার অর্থ।
ফেনসিডিল খেতে প্রতিদিন বেশ টাকা লাগে্ কিন্তু ফেনসিডিল এ আসক্ত একজন বেকার তরুণ বা যুবক প্রতিদিন এত টাকা কোথায় পাবে? ফলে প্রথমে পরিবার থেকে নানা অজুহাতে মিথ্যে কথা বলে টাকা নিতে শুরু করে। পরে পরিবার আর না দিতে পারলে বা নেশার কথা জেনে গেলে (যখন টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়) শুরু করে ছোটখাটো চুরি বা ছিনতাই। অনেক সময় নিজেই হয়ে যায় মাদকের খুচরা ব্যবসায়ী।অথবা নেশার টাকা যোগাড়ের ধান্দায় বাবা-মাকেও খুন করতে মাদকসেবীরা একদমই পরোয়া করে না।কারণ এ নেশা তো মরণবাণ। এ বাণকে তাই বলা যায় নীতি হরণকারী এবং জীবনসংহারী।
ফেনসিডিলের সে রমরমা বাজারে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। তবে সেখানে কোন শূন্যতা নেই। কারণ, তার জায়গায় নাকি এসেছে ইয়াবা নামের আর এক বিধ্বংসী মরণ নেশা। সংক্ষেপে নাকি তা ‘বাবা’ নামে পরিচিত। ফেনসিডিলও সংক্ষেপে ‘ডাইল’ নামে পরিচিত-এসব হয়ত সকলেই জানে। ইয়াবাই তো মাদকসেবীর কাছে সত্যিকারের বাবা! না হলে এ কথিত ‘বাবা’ আসক্ত ছেলে/মেয়ে কিভাবে পারে জন্মদাতা বাবা-মাকে খুন করতে?উদাহরণ হিসেবে নিশ্চয় আমরা ঐশীর কথা ভুলে যাইনি!
ফেনসিডিল আর ইয়াবা-এ দুটোর আতুড় ঘর হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আর মিয়ানমার। ভারতে ফেনসিডিল পাবেন না। মিয়ানমারেও হয়ত ইয়াবা পাবেন না। তাহলে সেখানে এগুলো কেন তৈরি হচ্ছে? কারণ হচ্ছে, এসব মাদক দ্রব্য তৈরির কাঁচামাল ওসব দেশে সহজপ্রাপ্য হওয়ায় এ দেশেরই কিছু সমাজবিরোধী মানুষ সেখানে সেফ জোন হিসেবে সে দেশের সমাজবিরোধী, চোরাকারবারী মানুষের সহায়তা নিয়ে এগুলো তৈরি করে তা দেশে আনে।(অর্থবান, বিত্তবান এবং ক্ষমতাশালী অনেক মানুষও নাকি এর পেছনে রয়েছে!)। তবে, কক্সবাজার এবং ঢাকাতেও ইয়াবা তৈরির মেশিন জব্দ হওয়ার খবরও নানা সময়ে পত্রিকায় দেখে তো রীতিমত আতংকগ্রস্ত হয়েছি।
এছাড়া হেরোইন, পেথিডিন, কোকেন, ক্যাপ্টাগন, ডান্ডিও (পথশিশুরা ব্যবহার করে বেশি) কম-বেশি আমাদের দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত বছরের হিসাব অনুসারে, আমাদের দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা নাকি ৭০ লাখ।যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, এ সংখ্যা ৫০ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু আতংকজনক খবর হচ্ছে, এ মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশই হচ্ছে যুবক(সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ০২জানু, ২০১৬)। এ মাদকসেবীদের ৭০ শতাংশই আবার ইয়াবা আসক্ত যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫-৩৫ বছর (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন বা পেথিডিন এর মতো এত খারাপ, জীবন সংহারী মাদকের ব্যবসা করে কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করে, নিজে ভালো থাকে কিন্তু যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় তারা তাহলে কত ভয়ংকর? দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাদের কোন ভালবাসা নেই, নেই কোন মমতা বা দায়িত্ববোধও।দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিয়ে হলেও তারা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যখন সমাজের প্রভাবশালী, বিত্তবান এবং নীতিনির্ধারক মানুষদের ছত্রছায়ায় মাদকের এমন রমরমা ব্যবসা চলছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় তখন হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। একারণেই হয়ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় মাদকের ভয়াবহতার কথা স্বীকার করে জনসচেতনতার উপর গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছেন। না হলে মাদকের কাছে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও তিনি অস্বীকার করেননি (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ০২জানু, ২০১৬)।
তাই, আসুন মাদকের বিরুদ্ধে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে সচেতন হই। যেহেতু মাদকসেবীরা বয়সে তরুণ-যুবক সেহেতু আসুন পারিবারিক এবং সমজিকভাবেভাবে আমরা যেন সবসময় আমাদের চোখ, কান খোলা রাখি।সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, আচরনে কোন অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সাথে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে আগে থেকেই খোলামেলা আলাপ করতে হবে। তাহলে মন থেকেই সে মাদকগ্রহণে অনীহা দেখাবে।
আর যে সকল সন্তান ইতোমধ্যে এ পথে পা বাড়িয়ে নিজেকে সর্বনাশা খেলায় জড়িয়ে নিয়েছে তাকে এখান থেকে বের করে আনুন।পরিপূর্ণ চিকিৎসা করান সবার আগে। জেনেশুনে তার মিষ্টি কথায় বিভ্রান্ত হয়ে দয়া করে তাকে ব্যবসা বা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত রাখার মিথ্যে আশায় আরো টাকা দিয়ে বিপথে পরিচালিত করবেন না। অথবা বিদেশে পাঠিয়ে দিলে বা বিয়ে দিয়ে দিলে সে ভালো হয়ে যাবে এমন বোকামি করবেন না।কিন্তু অনেক বাবা-মা সেটা করে থাকেন। এতে হিতে বিপরীত হবে। আপনার সন্তান আপনার প্রশ্রয়ে আরো নষ্ট হয়ে যাবে।
এ সহজ কথাটা মনে রাখুন যে, মাদক ছাড়াতে চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই এবং সেটা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। এর বাইরে অন্য কোন সহজ, সোজা রাস্তা নেই।চিকিৎসা চলাকালীন এবং শেষে তাকে তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে আর কখনই দেখা করতে দিবেন না। ওদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনুন। ওদের সাথে মিশলে সে আবারো মাদকাসক্ত হয়ে যাবে। তবে, পরিবারের সমর্থন এবং সহযোগিতা পেলে মাদকাসক্ত সন্তান আবারো যে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে- সেটা মাথায় রাখুন। তাকে সঠিক নিয়মে এবং সঠিক রাস্তায় হাঁটতে সহযোগিতা করুন।
আসুন, পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা এবং সচেতনতা দিয়ে সকলে মিলে একটা মাদকমুক্ত সমাজ তৈরি করি। আর এভাবেই সমাজবিরোধী, নষ্ট-ভ্রষ্ট মানুষদের অসামাজিক, সমাজ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড রুখে দিই।আর আমরাই পারব-অন্তরে সে বিশ্বাসটা সদাসর্বদা লালন করুন। তাহলেই কোন কিছু অসম্ভব বলে বিবেচিত হবে না।
লেখক : চিকিৎসক।
এইচআর/এমএস