সব ভিন্নমত কি মত?
রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচরণ বা ভিন্নমতের কারণে নিষেধাজ্ঞার দৃষ্টান্তসমূহ বহুচর্চিত। নানা দেশের সরকার অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি লালন করে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অপছন্দের বক্তব্যকে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করার ঐতিহ্য এদেশে ছিল, এখনো আছে এবং থাকবে। কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানই তেমন। আইনী জটিলতা ও রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের ফাঁক গলেই মত প্রকাশের সংস্কৃতি চর্চা করতে হয়।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উঠলেই ফরাসি পণ্ডিত ভলতেয়ারের একটি মন্তব্য বারবার উচ্চারিত হয় – “আমি তোমার মতের সাথে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তুমি যাতে তোমার মত অবাধে বলতে পারো, তার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত”। উদার গণতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে সত্যিই এই বাক্যের তুলনা নাই। কিন্তু ভলতেয়ার নিশ্চয়ই একথা বলেননি যে, “তুমি অন্যের মত প্রকাশ বন্ধ করতে হত্যাকেও সমর্থন করে কথা বলবে, তবুও আমি তোমার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকব”।
দেশের মুক্তিযুদ্ধকে যে কটাক্ষ করেছে বারবার, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী বলেছে, নিজে লেখক হয়ে ব্লগার, মুক্তমনা লেখকদের খুনকে সমর্থন করেছে, জঙ্গিদের আপন করে নিয়ে উস্কানি দিয়ে চলেছে জঙ্গিবাদকে, তার জন্য আসলে নিয়ম বা উপদেশটা কি হবে তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
যে মত প্রকাশের ফলে অনেকের অনেক ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে, তা অবাধে প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত কি? প্রশ্নটিকে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিচ্ছিন্ন করে দেখবার কতটুকু উপায় আছে তাও জানা দরকার। নিরঙ্কুশ বা নিঃশর্ত স্বাধীনতার ধারণাটি, অন্তত সমাজের পরিমণ্ডলে, প্রয়োগসাধ্য কী?
গণতান্ত্রিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে সমাজের উপর এমন চাপ রাখার সুযোগ রাখলে তার অপব্যবহার হবেনা কি? ভিন্নমত দমনের যে কোন ধরনের চেষ্টা অবশ্যই গর্হিত। সমাজকে অবশ্যই এমন চেষ্টা প্রতিহত করবার জন্য সজাগ ও তৎপর থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণী আইন যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা হবে, সেটাই উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কোনও বিধানই রাখা চলবে না?
তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণের ফলে এই দুনিয়ায় অতি সহজেই একটি তথ্য বা মত দেশ-মহাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে বিদ্যুৎবেগে অগণিত মানুষের নাগালে পৌঁছে যায়, ফলে বিপজ্জনক তথ্য বা মতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। সেখানে ব্যক্তি সার্বভৌম, তার বিপুল ক্ষমতা। এই ক্ষমতা কে কিভাবে প্রয়োগ করছে তা নিয়ে কথা উঠবেই। ক্ষমতা থাকলে দায়িত্ব থাকে। তিনি জানেন, অনেক জানেন, ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমে অধিকার আছে বলেই যা ইচ্ছে তা-ই প্রকাশ করবেন, এমনকি দেশকে নিয়ে, দেশের জন্য যারা জীবন দিল তাদের কটাক্ষ করবেন?
কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেছেন, ‘আপনার জ্ঞানচর্চা যদি জাতির মননকে পিছিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে, তাহলে তা আমাদের দরকার নেই।’ স্বকৃত নোমান বলেছেন, “ভিন্নমতের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা। কিন্তু ভিন্নমতের নামে যে মত বা যা জ্ঞান মানুষের ক্ষতি ডেকে আনে, যে জ্ঞান জাতিকে চিন্তা-চেতনায় পিছিয়ে দেয়, যে জ্ঞান নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, যে জ্ঞান জাতিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়, যে জ্ঞান চিন্তার জগতে চিন্তাবদ্ধতা তৈরি করে, সেই জ্ঞান সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য। কিন্তু এই ক্ষতিকর জ্ঞান চেনার উপায়? উপায় হচ্ছে কাণ্ডজ্ঞান। যার কাণ্ডজ্ঞান নেই তার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা মানে বৃথা সময় নষ্ট করা”।
ভাষা মনের ভাবকে নানাভাবে প্রকাশ করে। কথা যেমন সৎ মনোভাবকে প্রকাশ করতে পারে, তেমনই পারে অসততাকে প্রকাশ্য আনতে। একজন কবি ও প্রাবন্ধিক যেভাবে স্পষ্ট ভাষায় এক অন্ধকারের গোষ্ঠির প্রতি আন্তরিকতার সংকেত দিয়ে চলেছেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক নূতন পরিবেশ রচনা করেছে। যে কারণে আজ তার নিখোঁজ সংবাদে উদ্বেগ যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি উচ্চারিত হয় তার সম্পর্কে নানা নেতিবাচক বক্তব্য। একজন লেখক যখন টেলিভিশন স্টেশনে বোমা মারার জন্য নির্দেশ দেন, যখন মুষ্ঠি পাকিয়ে, গলার শিরা ফুলিয়ে আস্ফালন সমাজের সুস্থতাকে বিনষ্ট করতে তৎপরতা দেখান, তখন সব সুস্থ বদন অমলিন হয়। তার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে।
আসলে তিনি কোন স্বাভাবিক মত প্রকাশ করেন না। দীর্ঘ দিন ভুল অভ্যাসের মধ্য দিয়া বিচ্যুতও হয়েছেন। তার অসহিষ্ণুতা, আপন মতকেই একমাত্র যথাযথ মত বলে মনে করবার অহমিকা, বিরোধসর্বস্ব চেতনা, যে চেতনা বিরোধ ভিন্ন অন্য কিছু বোঝে না, ভিন্নমতাবলম্বীকে ধ্বংস করবার আদর্শ তার অন্তরে লালিত হয়েছে সর্বদা। তাই আজ যখন সব সুললিত বাণী তাদের উপর বর্ষিত হচ্ছে যারা তার সমালোচনা করছে, আশা করবো সেই প্রভাব ব্যাপক এবং গভীর হবে, তার চেতনাও বদলাবে।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস