আলোর জগতে বিনিয়োগ
An investment in knowledge pays the best interest - Benjamin Franklin
শিক্ষায় বিনিয়োগ মানে আলোতে বিনিয়োগ। আলোর আবির্ভাবে যেমন অন্ধকার পালায়, তেমনি বিদ্যা লাভে অবিদ্যা পালায়। বাংলাদেশের এখনকার বাস্তবতায় একথাটাই বারবার মাথায় আসছে। এ জাতি এতো এগুলো, এতো এতো উন্নতি করলো নানা ক্ষেত্রে, তবুও কেমন যেন একটা অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরছে। তবে কি বিদ্যান, আলোকিত মানুষের বড় অভাব আজ আমাদের?
দেশের শিক্ষার চেহারাটা নিয়ে যেসব উদ্বেগ চারদিকে, তার একটা প্রধান হল শিক্ষার গুণগত মান। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণ এশিয়ার খুব কম দেশেই এমন কাঠামো আছে। এর কারণে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে ভরসা জেগেছে, স্কুলমুখী হচ্ছে শিশুরা। বিশেষ ভাবে বেড়েছে ছাত্রীসংখ্যা। এই সব কিছু আশা জাগানিয়া। কিন্তু প্রশ্ন অনেক মান নিয়ে। শিক্ষার গুণগত মানই বা কি, তাকে কীভাবে মাপা হবে, এনিয়ে সমাজে বিভিন্ন অবস্থান আছে। সবচেয়ে বড় তর্ক শিক্ষা আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য? নাকি একটা চাকরি যোগানোর জন্য? এ বিতর্ক থাকবে। কিন্তু ন্যূনতম একটি মান নিশ্চিত হওয়া দরকার, সে নিয়ে কোন তর্ক নেই। পড়তে, লিখতে, অঙ্ক করতে জানা মানুষই শুধু আমরা চাই, নাকি আমরা চাই এমন শিক্ষিত মানুষ যে সমাজে আলোর ঘাটতি পূরণ করতে পারে?
স্কুল পর্যায়ে দুটি সমস্যা অতি আলোচিত শ্রেণিকক্ষে কিছু না শেখা এবং অতি-গৃহশিক্ষক ও কোচিংনির্ভরতা। কোচিং-এ যাওয়ার প্রবণতা সর্বগ্রাসী। স্কুলের খাতায় নাম থাকুক, কিন্তু পাশের নিশ্চয়তা শুধু দিচ্ছে কোচিং বা গৃহশিক্ষক। কেন শুধু বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে পাশ করবে না, ভাল ফল করা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠলো, সেই প্রশ্নকেই শিক্ষা বিষয়ক আলোচনায় আগে আনতে হবে।
এখানেও কাঠামোর প্রশ্ন। তবে দালান কোঠার মতো কাঠামো নয়। আমাদের শিক্ষকরা একটা কাঠামোর মধ্যে পড়ান। সেই কাঠামো হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠ্যক্রম শেষ করতে হয়। তাই তার চিন্তা থাকে সিলেবাস শেষ করা, গুণগত মান নিশ্চিত করা নয়। কোন শিক্ষার্থী এগিয়ে গেলো, আর কে কে পিছিয়ে থাকলো, তাদের জন্য কি করা দরকার, সেই ভাবনা ভাবার অবকাশ নেই শিক্ষকদের। আরেক কাঠামো হলো, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত। শিক্ষকের সামর্থ্যর চেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাদের পড়াতে হয়।
একথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবেনা যে, গৃহশিক্ষক বা কোচিং নির্ভরতার চড়া হার স্কুলব্যবস্থার প্রতি অনাস্থারই প্রকাশ। তাই যত নামকরা স্কুল বা কলেজ হোকনা কেন, দিন শেষে তাদের শিক্ষার্থীদের সবার ভাল ফলাফলের নির্ভরতা কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষক। কাঠামোগত সমস্যা আরো আছে। স্কুল-কলেজগুলোর পরিচালনার ভার ধীরে ধীরে চলে গেছে রাজনৈতিক দলের হাতে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকছে, স্কুল-কলেজগুলো হয়ে যায় তাদের অধীনস্ত।
কোন শিক্ষিত বিদ্বান আর এসবের ধারে কাছে যেতে পারেন না। ফলে শিক্ষকতার চাকরিও হয়ে উঠছে রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার। তাই সরকারি বেসরকারি সব শিক্ষককেই এখন শাসক দলের ঝান্ডা নিয়ে মিটিং মিছিল করতে হয়। কাঠামো এমন শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেছে যে, শাসক দল বদলায়, কিন্তু অভ্যাস থেকে যায়। রাজনীতির প্রতি এমন বিশ্বাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর শিক্ষামুখী হতে দিচ্ছে না। এই ছবি বদলাবার দায়িত্ব রাজনীতিকদেরই। শিক্ষকদের দায়বদ্ধ করে তুলতে না পারলে শিক্ষার মেরুদÐ ভেঙ্গে যাবে, এতে করে উন্নয়নের পথে হাঁটার আর উপায় থাকবে না।
একটা প্রশ্নের উত্তর পাই না কখনো। আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেমন হয়? নাকি বেশিরভাগই আসলে শেষ পর্যন্ত কেবলমাত্র সার্টিফিকেট বিতরণ? যদি উৎকর্ষের ভাবনা থাকত তাহলে তো নিশ্চয়ই লেখাপড়ার মান নিয়ে ভাবনা থাকতো শিক্ষকদের। শিক্ষা বিভাগের সাথেই বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক কতটা শিক্ষাকেন্দ্রিক? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। কারণ আমরা প্রতিনিয়তই ভিন্ন কিছু দেখছি। আমরা প্রায়ই শুনছি, এতে এতো জিপিএ ফাইভ পায়, অথচ ভাল করে লিখতে বা বলতে পারে না। সাধারণ জ্ঞানের ঘাটতি অনেক। আর বিজ্ঞানে অনাগ্রহ তো এখন এক রোগে পরিণত হয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে শিক্ষর্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে ভাবা। শুধু পাস ফেল বা গ্রেড দিয়েই সব কিছু মূল্যায়িত হয় না। একজন ছাত্রকে তার না শিখতে পারার জন্য এক জায়গায় আটকে রাখা যেমন ঠিক নয়, তেমনই কোন কিছু না শিখিয়ে পরের স্তরে তুলে দেয়াও ঠিক নয়। আমরা এখনো ভাবছি না তার সাফল্য-ব্যর্থতাগুলোকে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা কি নেয়া দরকার তা নিয়ে। কত নম্বর পেল, সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু এটা জানা জরুরি যে, সে কতটা কী পারছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পাঠ্যবইয়ের হেরফের (সাম্প্রতিক কালে হেফাজতীকরণ), নানা পরিবর্তন ও বিবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশ কিছু শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক শিক্ষাকে শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারীকরণের ঝোঁক আছে, কিন্তু বালাদেশের আর্থিক সক্ষমতা এখন এমন এক জায়গায় এসেছে যে, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অনায়াসেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা সম্ভব।
শিক্ষা স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সাহস জোগায়। তাই নতুন করে একটা বড় পরিসরের আলোচনা প্রযোজন কীভাবে আলোর পথে যাত্রার স্বপ্ন পূরণ করা যায়। তাই হেফাজতের পরামর্শে পাঠ্যবইয়ে যে পরিবর্তনগুলো আনা হলো সেগুলো থেকে সরে আসতে হবে আগে। শিক্ষা সামাজিক আন্দোলন। এ পথ ধরেই নারী এগুবে, অন্ধকার থেকে সমাজকে নতুন আলো দেখাবে।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/জেআইএম