ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিদ্বেষের এযুগ সেযুগ

প্রকাশিত: ০৩:৫৯ এএম, ২৮ জুন ২০১৭

আমাদের শৈশবে পাড়ায় পাড়ায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের আনাগোনা করতে দেখেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা মা-চাচীদের সাথে কথা বলতেন। তাদের হাতে ব্যাগভর্তি কীসব জিনিসপত্র থাকতো। ব্যাগ থেকে বের করে দিতেন আর মা চাচীরা চোখের নিমিষে সেসব নিজেদের আঁচলের তলায় লুকিয়ে ফেলতেন।

প্যাকেটের মধ্যে কী আছে জিজ্ঞাসা করে কখনো কারো কাছে কোন সদুত্তর পাইনি। কৌতূহলী হয়ে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সেসব উপহার সামগ্রী আবিষ্কারের চেষ্টা চালাতাম। প্রায়শই সেসব পেয়ে যেতাম তোষকের তলায়। কত্ত বেলুন যে আবিষ্কার করেছি এভাবে! খেলার সাথীদের প্রত্যেকের বাড়ির বিছানার নিচ থেকে সংগ্রহ করে আনা বেলুন ফুলিয়ে আমরা নিয়মিত খেলতাম। আমাদের সময়ে খেলনাসামগ্রী বলতে ছিল শুধু এক পুতুল।

আজ কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করছি বাংলাদেশ সরকারের সরবরাহকৃত স্বাস্থ্যসামগ্রী কনডম আমাদের শৈশবের দিনগুলোকে দারুণভাবে বৈচিত্র্যময় করেছিল। আমরা শিশুরা তখন জানতাম না এটা ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী। শুধু বলতে চাই টার্গেট গ্রুপের বাইরে আমরা সমাজের বড় একটা অংশ ছিলাম কনডম খেলনার সুবিধাভোগী। পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের বেশিরভাগই ছিলেন মহিলা। তার অবশ্য কারণও ছিল। গ্রামীণ গৃহস্থ বাড়িগুলোতে প্রবেশ এবং মহিলাদের লজ্জা কাটিয়ে আস্থার জায়গা তৈরির বিষয়টি সহজ হতো। বেশিরভাগ বাড়ির মুরব্বীরা এসব কর্মীদের খুব অপছন্দ করতেন। অনেক বাড়িতে তারা ঢুকতেও পারতেন না। তাদের পাপিষ্ঠ জ্ঞান করা হতো কারণ তারা মানবজীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে ব্যাহত করতে চেষ্টারত। তারা বউ-ঝিদের পাপ শিক্ষা দিচ্ছেন।

`জীবন দেওয়ার মালিক যে, খাওয়াও দেবেন সে" এই ধরনের মনস্তত্ত্ব লালনকারী একটি গোড়া সমাজকে পট পরিবর্তনে কাজ করে সফল হওয়া পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের ঘৃণিত করে স্বাস্থ্য উপাদান প্রতিটা পরিবারে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছেন, একটি পরিবারে দুই সন্তানই যথেষ্ট সেটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের বৃহত্তর গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে অসচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা রোধে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের ভূমিকার কথা আমার ধারণা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। কে না জানে বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এগোতে জানলে সফলতা ধরা দেবেই। সঠিক ও সুন্দরের ক্রমাগত আহ্বান একসময় মানুষের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনে সাহায্য করে।

মানুষের স্বভাব হলো যেকোন পরিবর্তনই সে হুট করে গ্রহণ করতে পারে না। বাধা দেয়, তাতে সফল না হলে কুৎসা রটায়, তাতেও সফল না হলে শারীরিক-মানসিক আঘাত করে। পরিবর্তনের হল্কা পরিবর্তনকামীদের তাপবিদ্ধ করে চলে দীর্ঘদিন। যে এসব তাপদাহ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকে তাকেই কুর্নিশ করে পৃথিবী। হিসেবটা সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন থেকে কঠিনতর। মানুষের জীবনে পরিবর্তনহেতু সময়ের চাহিদা এক বিচিত্র ব্যাপার। একেক প্রয়োজন মেটাতে একেক সময়কে টার্গেট করে এগিয়েছি আমরা। সফল হয়েছি। আবার এমনও হয়েছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে অর্জিত কোন সাফল্যকে কোন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছিনিয়ে নিয়ে গার্বেজমুখি করেছে। অর্থাৎ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া নামক দুটি উপাদান পাশাপাশি অবস্থান করে।

নেতৃত্বের গুণে যেকোন একটা উপাদান শক্তিশালী হয়ে উঠে সমাজকে তখন নিজের আইডিওলজির দিকে নিক্ষেপ করে। ঠিক এমন একটা সমাজে এখন আমাদের বাস। যখন একজন নারী হয়েও আমি নিজের গুরুত্বপূর্ণ একটি পোশাক ব্রায়ের নাম উচ্চারণ করলে বলা হয় এটা নিষিদ্ধ, এই শব্দের প্রতি পুরুষের সেক্সুয়াল আপিল আছে। নারীর জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পিরিয়ড, পিরিয়ড শব্দে ও রক্তের দাগে সেক্সুয়াল আপিল আছে। ঘেমে নেয়ে একাকার হলেও নারীর চুল দেখানো যাবে না, চুলে সেক্সুয়াল আপিল আছে। ওড়না ছাড়া পোশাক পরিধান করা যাবে না, বুকে সেক্সুয়াল আপিল আছে। জোরে হাসা যাবে না, হাসির শব্দে সেক্সুয়াল আপিল আছে।

একজন পুরুষের সেক্সুয়াল আপিল বিষয়ক তথ্য একজন নারীর জানার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি করি না। সেসব বিবেচনায় এনে কোন নারীর আলখাল্লা পরিধানকেও একেবারেই সঙ্গত মনে করি না। নারী ও পুরুষ উভয়েই মনুষ্য প্রজাতি, একে অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী- আত্মীয়-বন্ধু-সহযাত্রী, সহজ কথায় একে অপরের পরিপূরক। নারীকে তার পোশাক ও নিজের শরীর বিষয়ক ভাবনাতে আবদ্ধ করাটা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির একটা কূটকৌশল।

নারীকে বাহিরের কাজে নিষ্ক্রিয় করে ঘরমুখো করার চেষ্টা এবং তাদেরকে ঘর গৃহস্থালির কাজে লাগিয়ে পুরুষের নিত্য নৈমিত্তিক স্বাচ্ছন্দ্যকে ষোল আনা উসুল করাই ছিল সেই রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। বলা যায় রাজনীতির সেই কূটচালে পুরুষতন্ত্র সফল হয়েছে ভীষণভাবে আর সফলতা অর্জনে চিরকাল সহায়তা করেছে নারীগণই। শুধু পুরুষই নন, মগজে ও মননে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির ধারক ও বাহক খোদ নারীরাই। এসব নারী নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের ভার ছেড়ে দিয়েছে পুরুষের চাহিদার ওপরে। পুরুষের ভালো লাগলে তার ভালো লাগে, পুরুষের খারাপ লাগলে তার খারাপ লাগে। ঠিক এখানেই পুরুষতন্ত্র সফল।

আমি অনেক পুরুষকে বলতে শুনেছি- নারী তার যৌক্তিক অধিকার পাক আমরাও চাই কিন্তু পুরুষের প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়ে নারী কখনো তার অধিকার আদায় করতে পারবে না। এখানেও আছে তীব্র ভুল বোঝাবুঝি। আমরা বলতে চাই পুরুষের প্রতি বিদ্বেষ নয়, পুরুষতন্ত্রের প্রতি নারীর এই তীব্র অনাস্থা। আমি বিশ্বাস করি যা কিছু সুন্দর, সত্য ও মঙ্গল সেটার বাস্তবায়নজনিত মেয়াদ সবসময়ই দীর্ঘ হয় কিন্তু ক্রমাগত সেই পথে হেঁটে চলার মধ্যেই আছে সফলতা। ঠিক যেমনটি করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যখাতের অধীনে কাজ করে যাওয়া পরিবার পরিকল্পনা কর্মীগণ। আজকে তাই নারীর প্রতি আহ্বান নারী তুমি নারী থেকে বেরিয়ে প্রথমে মানুষ হও। তোমার ব্রা তখন কারো প্রতি আর আপিল সৃষ্টি করবে না, তোমার গোপন পোশাক হিসেবেও সেটি আর কারো কাছে গণ্য হবে না।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন