ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পাহাড় ধসে মৃত্যু : আর কত?

প্রকাশিত: ০৪:০০ এএম, ১৪ জুন ২০১৭

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসে মানুষের করুণ মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে আসে। তারপর যা হয় তা সকলেরই জানা। সংবাদ মাধ্যমে একটু লেখালেখি, শোকপ্রকাশ আর টিভি টকশোতে কিছু কথাবার্তা। ব্যস। আর কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নেই কোন প্রতিবাদ। কার্যকর ব্যবস্থা তো গ্রহণ করাই হয় না। সাধারণত পাহাড় ধসে দরিদ্র মানুষরাই মারা যান। আর দরিদ্র মানুষের মৃত্যু কি  বড় কোন  ব্যাপার নাকি? আমাদের দেশে তো আর গরীব মানুষের অভাব নেই। তাই তাদের জীবন বড়ই সস্তা।

চলতি সপ্তাহেই চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় ১৩২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন। চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দুর্গম এলাকায় দুর্ঘটনাস্থলে তো উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতেও দেরি হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ধার করতে গিয়ে হতাহত হয়েছেন ৪ জন সেনাসদস্য। পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে বলা হয় বৃষ্টিতে মাটি সরে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তাই এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু সত্যিই কি এই দুর্ঘটনার  জন্য একমাত্র প্রকৃতিই দায়ী? এর পেছনে কি মানুষের হাত নেই? অবশ্যই আছে। আছে অতি কুৎসিত লোভের কর্কশ থাবা। প্রতিবছরই এই লোভের থাবার আঘাতে প্রাণ হারায় কিছু মানুষ। 

এর আগে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম নগরীতেই বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।এবছর আরও কত জনের মৃত্যু হবে কে জানে। পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো অবৈধভাবে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা। দুর্বৃত্ত ঠিকাদাররা অবৈধভাবে পাহাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যায় বিপুল পরিমাণে। এই মাটি তারা বিক্রি করে উচ্চ মুনাফায়। খুব লাভের ব্যবসা এটা। আর পাহাড়ের গাছ কাটা তো রীতিমতো ধনী হওয়ার সোজা রাস্তা। বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে সামান্য ঘুষ নিয়ে। অথচ ব্যক্তিগতভাবে ধনী হওয়ার জন্য এরা ধ্বংস করছে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন।

গাছ তার শেকড়ের সাহায্যে মাটি ধরে রাখে। মাটিকে জমাটবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। আসবাবের কাঠ, জ্বালানি কাঠ , খুটি তৈরির কাঠ -এ সবের জন্য উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের বৃক্ষসম্পদ। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। যে ঠিকাদাররা দুর্দমনীয় লোভে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে এই অপকর্মগুলো করে তাদের কিন্তু পাহাড় ধসে মৃত্যু হয় না। মৃত্যু হয় গরীব মানুষের। যারা বাস করে ওই পাহাড়ে। পার্বত্য জেলাগুলোতে এই দুর্ঘটনা ঘটলে মরে পাহাড়ি দরিদ্র জনগণ আর চট্টগ্রাম শহরে ঘটলে মরে বস্তিবাসী বাঙালি। দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্ররা এই দুর্ঘটনার শিকার হয় বলে তাদের মৃত্যু শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি সংখ্যামাত্র। মানুষের মৃত্যুর যে কোন ক্ষতিপূরণ হয় না সেটি যে বিপুল মানবিক বিপর্যয় সে কথা কে মনে রাখে। পাহাড় ধসে মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য দরকার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ।

প্রথমত তো অতি আবশ্যিকভাবে পাহাড় কাটা আর বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। এটা শুধু পাহাড় ধস ঠেকানোর জন্য নয়, সেইসঙ্গে পরিবেশ রক্ষার জন্যও অতি জরুরি। কিন্তু এই জরুরি কাজটা করতে হলে লোভী, দুর্বৃত্ত ঠিকাদারদের লাভের ব্যবসায় ভাটা পড়বে। আর ঘুষখোর কর্মকর্তাদের পকেটে ঘুষের টাকার আমদানি কমে যাবে। তাই ধ্বংস হোক পরিবেশ, ধসে পড়ুক পাহাড়, মরুক মানুষ। কুছ পরোয়া নেই।  পাহাড় তারা কাটবেই, গাছ তারা কাটবেই। এই অপরাধের যেন কোন শাস্তি নেই, প্রতিকার নেই। আর এই ঘুষখোর কর্মকর্তা আর দুর্বৃত্ত ঠিকাদারদের লোভের বলি হচ্ছে সাধারণ দরিদ্র মানুষ। ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য ধ্বংস হচ্ছে শুধু কিছু সংখ্যক দুনীর্তিবাজ কর্মকর্তা আর দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে।

পাহাড় ধসে মৃত্যু প্রতিরোধে আরও ব্যবস্থা নেওয়ার আছে। যেহেতু প্রতি বর্ষা মৌসুমেই পাহাড় ধসের আশংকা থাকে তাই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাসকারী মানুষজনকে আগেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার সরকারি উদ্যোগে। সরকারি বিশেষজ্ঞদের পক্ষে তো আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা সম্ভব।  ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেলে তো আর এই প্রাণহানি ঘটে না। এবং সেটি করতে হবে শুকনো মৌসুমেই। কিন্তু কার গোয়ালে কে বা দেয় ধুঁয়ো। দরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালিকে নিয়ে ভাবে কে, আর সেই কাজে উদ্যোগই বা নিবে কে?

পাহাড়ে এই করুণ মৃত্যু আর দেখতে চাই না। প্রতিকার, প্রতিরোধ সবই গ্রহণ করতে হবে। পাহাড় ধস বন্ধে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের টনক নড়া দরকার। বন্ধ করতে হবে পাহাড় কাটা আর বৃক্ষ নিধন।  আর যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের দিতে হবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ। যদিও মানুষের জীবনের কোন ক্ষতিপূরণ হয় না। তবু দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া দরিদ্র মানুষদের যদি অর্থ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তাদের দুর্বিষহ শোক কিছুটা হলেও তো লাঘব হয়।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন