হেফাজতকে জামায়াতমুক্ত করুন
হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তি। ২০১৩ সালের ৫ মে এই শক্তিটি যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও চেতনার পরিপন্থি তা জানান দিয়েছিল। আর গত কয়েক বছর ধরেই এর শেকড় পৌঁছে গেছে আরও গভীরে। তারা নারী বিদ্বেষী। টার্গেট তাদের ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার। আগ্রাসী শরীরী ভাষায় তারা দেশের প্রগতিশীল সমাজের প্রতি আক্রমণ করছে। বিরুদ্ধ পক্ষের মুখ বন্ধ করছে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে। প্রতিটি বিজয় তাদের লোভী ও উৎসাহী করে তুলেছে আরও বড় কোন দাবি আদায়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এখন তাদেরকে বুঝে সমঝে চলছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের সরকারও। আগে ছিল শুধু আস্ফালন। এখন সেটি একটি ভয়ঙ্কর শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলছে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
দেশের মানুষদের একটি বড় অংশ জানে বাংলাদেশে ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে একটি অগোছালো সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তারা কিভাবে এত দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠলো? কারা আছে এর পেছনে? কী তাদের উদ্দেশ্য? ২০০৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে সম্মিলিত ধর্মভিত্তিক সংগঠনের মোর্চা ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর নাম। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ ঘটনার যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানে চালু হওয়া হুদুদ আইনের সঙ্গে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এ আইনটির প্রবর্তন করেন। আর এ কারণে পাকিস্তানের নারীর নিরাপত্তা ও জীবন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ২০০৩ সালে জাতীয় সংসদে হুদুদ আইনের আদলে একটি আইন তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী। ড. রিয়াজের মতে ২০০৭ সালে হেফাজতের তের দফায় ছিল এই আইনেরই প্রতিচ্ছবি।
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে মাঠে নামানো হয় হেফাজতকে। সেদিনের ‘ইসলাম রক্ষার’ ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পেছনের মূল শক্তিটি ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবিরই। যা পরবর্তীতে গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। দুইদিনের সেই আন্দোলনে হেফাজত জানান দিয়েছিল সুযোগ পেলে তারা কত বড় দানব হয়ে উঠতে পারে। সেদিন নারী হয়ে পুরুষদের অনুষ্ঠান কাভার করার অপরাধে মতিঝিলের রাজপথে বিশ ত্রিশজন হেফাজত কর্মী প্রকাশ্যে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছিল ইটিভির সাংবাদিককে। সেদিন শান্তির ধর্ম ইসলামকে কলংকিত করেছে তারা পবিত্র কোরান শরিফ পুড়িয়ে।
এবছরের শুরুতে আবার জেগে উঠেছে হেফাজত। এবার তারা আরও সংগঠিত। আরও সোচ্চার ও পরিপক্ক দাবি আদায়ে। এবার তাদের টার্গেট বাংলাদেশকে সাম্প্রাদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাদের কথায় পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়। এরপর তারা আঘাত করেছে আবহমান বাংলার সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর ওপর। তারা দাবি তুলেছে ‘পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের উৎসব, এটা বাতিল করতে হবে।’ তাদের দাবির মুখে কওমী মাদ্রাসার দাওরা-ই হাদিস পাঠ্যক্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো মাস্টার্স সমপর্যায়ের। এরপর আসলো ‘হাইকোর্টের’ সামনে থেকে থেমিসের ভাস্কর্য সরাতে হবে। সেটাও সরকার মেনে নিয়ে প্রধান ফটক থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে এনেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করলো। তাতেও সন্তুষ্ট নয় তারা, আবারও খেপে উঠলো হেফাজত। গত ২ জুন শুক্রবার বাইতুল মোকারমের সামনে তারা স্পষ্টই চ্যলেঞ্জ দিয়ে বলেছে এনেক্স ভবনের সামনে থেকেও ভাস্কর্যটি সরাতে হবে। শুধু তাই নয়; অপসারণ করতে হবে দেশের সব ভাস্কর্য।
এসব দাবির উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো। প্রভাব ইতিমধ্যে পড়েছেও সমাজে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর গবেষণা বলছে, ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৫২১ জন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৪৩৮ জন। ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিদিন ৭৬৭ জন হিন্দু দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৭৪ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
আসলে বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাঁধে ভর করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাষ্ট ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার বাসনা অনেকদিনের পুরনো। আবার রাজনৈতিক দলগুলোও ধর্মীয় দলগুলোর ভোট পাবার জন্য সদা সচেষ্ট। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাঁধে ভর করে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বেশ পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এখনও জামায়াতি ছায়া থেকে মুক্তি পায়নি বিএনপি। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের সুসম্পর্ক একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। বিএনপির গায়ে যে সাম্প্রাদায়িতার কলঙ্ক লেগেছিল, যদি হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে আওয়ামী লীগকেও একই ধরনের কলঙ্কের দায় বইতে হবে।
ধর্মীয় দলগুলোর উত্থানে কী হতে পারে তা আফগানিস্তানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বৃটেনের এক বছর আগে ১৯১৮ সালে আফগান নারীরা ভোটের অধিকার লাভ করেছিল । সেই আফগান নারীদের ঘরে ফিরে যেতে হয়েছে ১৯৯৬ সালে যখন দেশটিতে তালেবানদের হাত ধরে ধর্মীয় শক্তির উত্থান ঘটেছিল। এর পর দেশটি তছনছ হয়ে যায়।
হেফাজতকে নিয়ে মূলত পর্দার আড়াল থেকে খেলছে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা জামায়াত। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়েই প্রকাশ্যে সরব হতে দেখা যাচ্ছে হেফাজতকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে একসময়ে জামায়াতিদের মুখে যেসব দাবি-দাওয়ার কথা শোনা যেত এখন হেফাজতের মুখেও সেই একই দাবি। এদেশে মাদ্রাসার ছাত্রদের একসময়ে শেখানো হয়েছে জামায়াতে ইসলামীই একমাত্র দল যারা তাদের পক্ষে কথা বলে। তাদের স্বার্থ রক্ষায় সব সময় জামায়াতিদের পাশে পাওয়া যায় এমনটা তারা জেনে আসলেও বাস্তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের যা দিয়েছে অতীতের যে কোন সরকারের চেয়ে তা অনেক অনেকগুণ বেশি। অতীতে রাষ্ট ক্ষমতায় যারাই বসেছেন তারাই এদের ব্যবহার করেছে। কাজেই সত্যিকারে যদি দেশের মঙ্গল আনতে হয়; অশুভ শক্তির বিকাশ রুখতে হবে। এবং তা এই হেফাজতকে জামায়াতমুক্ত করে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস