বিচ্ছেদে মেলায় বস্তু
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :
বিদেশি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ছুটির দিন ওপার থেকে আসা শিল্পীর গান শুনতে যাওয়া। দেখা হয়ে গেলো বন্ধুর সঙ্গে। প্রায় পঁচিশ বছর পর। মেয়েটি নিজেও গাইতেন। ভালো গাইতেন। ক্যাম্পাসে কতো রোদে, কতো কতো আড্ডায়, কতো গাছের নিচে, কতো করিডোরে তার গান শুনেছি। কার সঙ্গে যেন প্রাণ বেঁধেছিল এবং সে তাকে তার ঘরের চাবি ভেঙে নিয়ে গিয়েছিল, পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই। অনার্স এখানে করলেও মাস্টার্স করেছিল বিদেশে তার বরের কর্মস্থলে।
তাই প্রথমেই বললাম, একাই এলে, না বরকে এনেছ? উত্তর এলো, ‘আমি এখন একাই’। জানালো তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি প্রায়ই। এদিক-ওদিক থেকে পরিচিতজনদের এমন খবরে একসময় চমকে উঠতাম, এখন দেখছি, অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একটা সময় এসব নিয়ে আলোচনা প্রকাশ্যে হতোনা, এখন অনেকেই খোলাখুলি কথা বলে এ নিয়ে।
আমার বন্ধু বলে সে, কারণটা খুঁজেছে অনেকদিন। নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে কেন বিয়েটা ভাঙলো? ভালোবাসার বিয়েইতো ছিল ওদের। নিজেই আবার উত্তর দেয় আসলে বিয়েটাকে প্রেমের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধরে নিলে ভুলের শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রেমের একটা শারীরিক লাইসেন্স নিশ্চয়ই বিয়ে, তবে শরীরেই তো আর থিতু হয় না প্রেম, ডানা মেলতে চায় আরো দূরে। সংকটের শুরুটা সেখান থেকেই। প্রেম, প্রেমের পর বিয়ে।
এর কিছুদিন পর থেকে এই মানব-মানবীরা শরীর বিনিময়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই তাদের প্রেমের পুরনো বা প্রথম দিককার অনুভূতিগুলো ফিরে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মেয়েটি বুঝতে পারে দাম্পত্যের দৈনন্দিনে স্বামীটির দিক থেকে সে আর তাদের প্রেমের আদি অনুভূতিগুলো ফিরে পাচ্ছে না। প্রত্যাশার এই জায়গাটি বাস্তব কারণেই যে অসম্ভব তা বুঝতে পারে না। পুরনো রং-এ ফেরা যায় না, ফেরেওনা কেউ। আর এ থেকে শুরু হয় দু’জন থেকে দু’জনের দূরে যেতে থাকা।
আর আছে সন্দেহ। যদি স্ত্রীর মাথায় একবার ঢুকে যায় তার স্বামীটি দ্বিতীয় নারীতে আসক্ত হয়ে আছে, কিংবা পুরুষটি যদি ভাবতে থাকে তার স্ত্রী বোধহয় দ্বিতীয় পুরুষের বাহু বন্ধনে আছে, তাহলে কে আর রুখে বিচ্ছেদ। আমার বন্ধু বলে তার বেলায় ঘটেছিল এমনটিই। তার ভাষায় তার স্বামী নামের ‘মহাজন’ এমন এক সন্দেহ থেকে তাকে অনুসরণ করতো। পায়নি কিছুই কোনোদিন। কিন্তু ও যখন জানতে পারে তার বর তাকে অনুসরণ করে, বিশ্বাসের দরজাটি ভেঙ্গে যায় সেদিনই। ‘সে ছিল এক অন্যরকম অপমান, ইট ওয়াজ এ সাফোকেটিং লাইফ, আই ওয়াজ সাফারিং সিরিয়াসলি, তুমি বুঝবে না’, ছবি দেখা শেষে কফি শপে বসে বলে আমাকে। হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারি না, তবে দেখতে পাই ঘরে ঘরে এমন সব ঘটনা।
জীবনের ওপর দিয়ে এমন একটা ঝড়ের পর তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা বেড়েছে বোঝা যায়। বলে, তোমরা পুরুষরা possess করতে চাও মেয়েদের, তোমাদের স্ত্রীদের। আর এই দখলদারিত্বের মানসিকতাই তোমাদের ক্রমশ দূরে ঠেলে দেয় তোমাদের স্ত্রীদের থেকে। বলে, তোমরা পুরুষরা দখলকে প্রেমের পরিপূরক হিসেবে দেকো বলে মেয়েটিকে তো পাওয়া আর সম্ভব হয় না, তার নিজস্বতাকেও ছুঁতে পারা যায় না। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত পুরুষের কাছে প্রেমের একটা শারীরিক পরিণতিই হয়ে থাকে, মানসিক সুখ হয়ে ওঠে না।
এ যে দখলদারিত্বের অভ্যেস, তা থেকে পুরুষ কিছুতেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না। আমি বলি, মেয়েরাও যে দখল করতে চায় না তা কিন্তু নয়। সে বলে হ্যাঁ আছে, তবে আনুপাতিক হারে কম। পিতৃতন্ত্রের শাসনেই তো চলে গোটা সমাজটা, ফলে দখলটাকে যেকোনো সম্পর্ক কিংবা প্রেমে আবশ্যিক বলে ঠাওর হয়। জিজ্ঞেস করি, গানটা গাওয়া হয় কি-না। বলে, সেটাও ছেড়েছি সবকিছুর সঙ্গে।
বিদায়ের সময় বলে, ‘আমি বিচ্ছেদে ভালো আছি, নিজের মতো আছি, বিচ্ছেদে মেলায় বস্তু, সংসারের তর্ক বহুদুর নিয়ে যায়’।
লেখক : পরিচালক বার্তা, ৭১ টিভি
এইচআর/বিএ/এমএস