বিশ্বকে যা দিতে পারে বাঙালি
যুক্তরাজ্যের পর ইরান। সন্ত্রাসী হামলা চলছেই। সারা বিশ্বেই অশান্তি। মানুষের উপর মানুষের হামলা। মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা। কে মুসলমান, কে খ্রিস্টান, কে ইহুদি, কে বৌদ্ধ আর কে নাস্তিক সেই হিসেব কষতে সভ্যতা এত বেশি ব্যস্ত যে কে মানুষ তা জানতে আজ আর কারও আগ্রহ নেই।
বিশ্বের কেউ আর আজ নিরাপদ নয়। কোথাও নিরাপদ নয়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মতো সুরক্ষিত দেশেও ঘটছে সন্ত্রাসী হামলা। ইরানে তো মুসলমানরাই সর্বত্র। সেখানেও ঘটছে হামলা। এখন আর ভিন্ন ধর্মের প্রশ্নও উঠছে না। ইসলামের মধ্যেও কোথায় কে শিয়া, কে সুন্নী, কে কুর্দি এসব নিয়েও চলছে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশেও আবিষ্কৃত হচ্ছে একের পর এক জঙ্গি আস্তানা। সেই আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে শুধু জঙ্গি নয়, মরছে অন্য মানুষও। সভ্যতার এই সংকটে মনে পড়ছে লালন সাইজির কথা ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা’ ‘কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়/তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিম্বা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে’ ।
হ্যাঁ এখানেই বিশ্বে রাখতে পারে বাঙালি তার শ্রেষ্ঠ অবদান। আর তা হলো সকল জাত ধর্মের উর্ধ্বে মানবতার কথা বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। বাংলা চিরদিনই ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবপ্রেমের পীঠস্থান। এই বাংলাতেই চণ্ডীদাসের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। প্রাচীন বাংলায় নাথপন্থী এবং পরবর্তীতে বৈষ্ণব, বাউলরা শুনিয়েছেন মানবসেবার মধ্যেই ঈশ্বরকে পাওয়ার কথা। ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ একথা উচ্চারণ করেছে বাঙালি। ‘যত মত ততো পথ’ এই কথাটিও ধ্বনিত হয়েছে বাঙালি সাধকের কণ্ঠেই। এই সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস পরমত সহিষ্ণুতার কথা বলেছেন মুক্ত কণ্ঠে।
পরমত সহিষ্ণুতা। তারমানে অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আমি আমার স্রষ্টাকে যে নামে ডাকি, যে রীতিতে তাঁর উপাসনা করি সেটা তোমার চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে। তুমি হয়তো তাকে ডাকো ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন নামে, ভিন্ন রীতিতে। কিংবা হয়তো তুমি তাঁকে ডাকো না। আমি একজনকে ডাকি, তুমি হয়তো একজনকেই নানা রুপে ডাকো। তাতে কি? তোমার আমার মানুষ পরিচয় তো সেজন্য খারিজ হয়ে যাচ্ছে না। অথচ কী ঘটছে? আমি হামলা করছি তোমার উপর, তুমি হামলা করছ আমার উপর। কেন? কারণ আমাদের ভাষা ভিন্ন, ঈশ্বরকে ডাকার রীতি ভিন্ন। কিংবা আমার ঈশ্বরকে তুমি মানো না অথবা তোমার ঈশ্বরকে আমি মানি না। এর কোন মানে হয়? সবার উপরে মানবধর্মই যে চূড়ান্ত একথা কি আমার আগে আমার পূর্ববর্তী মানুষরা বলে যাননি?
বাংলার কবিরাও সব মত, পথ, ধর্মের উর্ধ্বে মানবতাকে স্থান দিয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি’। বাংলার কবিরা বলেছেন, ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত’।
আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অসংখ্য লেখায় সকল ধর্মের উপরে মানবতাকে স্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে নায়ককে প্রথমে ধর্মীয় গোড়ামিতে আকীর্ণ দেখিয়েছেন। পরে নায়ক গোরার উপলব্ধি যে, হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এসব ধর্মীয় বিভেদ সব ভ্রান্ত। মানুষ এই পরিচয়ই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের রচনার মূল সুরই ছিল মানবতাবাদ। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন’ ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’,‘হায়রে ভজনালয় তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়’ ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন’ নজরুল তার সাম্যবাদীসহ অসংখ্য কবিতায় বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঘুচিয়ে মানব ধর্মকে বড় বলে তুলে ধরেছেন।
অস্থির এই বিশ্বকে বাঙালি এখন যা দিতে পারে তা হলো অসাম্প্রদায়িক, মানবপ্রেমের আদর্শ। আমাদের দেশে আমরা যুগ যুগ ধরে যার যার ধর্ম পালন করেও যে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছি, বাঙালির সমাজ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিক সেই অসাম্প্রদায়িকতার রূপটিও কিন্তু আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। বাঙালির ভিতরেও ঢুকে পড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত কালনাগিনী। এই কালনাগিনী আমাদের ছোবল মারতে উদ্যত হযেছে। এ থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানো দরকার সর্বাগ্রে।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল স্বাধীন হয়েছিল ধর্মীয় গোড়ামির ভিত্তিতে নয়। বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বুকে ধারণ করে। আমাদের সেই আজন্ম লালিত বিশ্বাসকে আবার দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন আমাদের স্কুল কলেজ সর্বত্র সাংস্কৃতিক আান্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন, জীবনানন্দ দাশ , মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বাঙালি মনিষীদের মানবতার বাণীগুলো আবার জোরে শোরে উচ্চারণ করতে হবে, পৌঁছে দিতে হবে আগামী প্রজন্মের কাছে। আর সেই সাথে বাঙালি মনিষীদের মানবতার এই কথাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। বিশ্ব দেখুক বাঙালি কত বছর আগেই সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠেছে। বিশ্ব দেখুক বাঙালির মানবতার আদর্শ। বিশ্ব উপলব্ধি করুক বাংলার বাউল বৈষ্ণব, সাধু, সন্ন্যাসী, ভিক্ষু, সুফীসাধকদের মানবপ্রেমের কথা।
বিশ্বকে বাঙালি উপহার দিতে পারে লালনের , রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের আদর্শ। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে এই আদর্শের প্রচার দরকার। একসময় এদেশে পাড়ায় মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসাহভরে অংশ নিতেন। নাটক, গান, কবিতা বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। সেখানে দেশপ্রেম, মানবতা ইত্যাদি বিষয় থাকতো। এখন সারা দেশে আবার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। যাতে সাধারণ মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত প্রভাব দূর হয়। পাড়ায় পাড়ায় গঠন করা দরকার বিজ্ঞান ক্লাব, সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। আমাদের মানবপ্রেমের ঐতিহ্যকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। আর বিশ্বকে দেখাতে হবে বাঙালি শুধু কথায় নয়, কাজেও বিশ্বাস করে সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম