ধর্মের নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হবে কবে?
মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, মৃত্যুর অন্ধকার পেরিয়েও রয়েছে আশার আলো। ধর্ম যুগে যুগে মানুষকে হতাশার মধ্যেও আশা জাগিয়েছে। কিন্তু ধর্মের নামে যখন চলে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা তখন তাকে কী বলা যায়? অতীতে ধর্মের নামে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে ডাইনি অপবাদে, সহমরণে পাঠানো হয়েছে, নরবলি দেওয়া হয়েছে। আরও নানা রকম শোষণ, নিপীড়ন হত্যা করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের নামে। বর্তমানেও ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, মৌলবাদ, মানুষকে হত্যা, জনসমাবেশে হামলা চলছেই। এই তালিকায় ম্যানচেস্টারে সাম্প্রতিক হামলার বিষয়টি নতুন সংযোজিত কালো অধ্যায়। ২২টি প্রাণ ঝরে গেল এই বোমা হামলায়।
গুলশানের হলি আর্টিজান, ফ্রান্সে হামলা, ইংল্যান্ডে হামলা, জার্মানিতে হামলা, এবার আবার ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে হামলা। চলছেই। নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরা থামছে না। থামছে না জঙ্গিবাদের ছোবল। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এইসব হামলা, হত্যা, আক্রমণ সবটাই ঘটছে ধর্মের নামে। পরম পবিত্র, পরম কল্যাণময় ঈশ্বরের নাম নিয়ে মানুষ হত্যা করছে মানুষকে। এটা যে কত বড় দুঃখের ও বেদনার তা ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝবেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় একের পর এক অভিযান চলেছে। কিন্তু তারপরও গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না যে, জঙ্গিবাদকে নির্মূল করা হয়েছে। সারাবিশ্বেই এই যে জঙ্গিবাদের উত্থান-তার আশু সমাধান দরকার।
সবচেয়ে আগে দরকার তরুণ প্রজন্মকে জঙ্গি হওয়া থেকে বাঁচানো। জঙ্গি হওয়ার উৎসমুখকে বন্ধ করতে পারলে তবেই জঙ্গিবাদকে ঠেকানো সম্ভব। আসল কথা যতদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য অস্থির থাকবে, অশান্ত থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত বিশ্ব থেকে জঙ্গিবাদ দূর করা যাবে না। কারণ নানা রকম ক্ষোভ ও অস্থিরতা থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত তরুণরা জঙ্গিবাদের দিকে পা বাড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিস্থিতি বিশ্বের অন্য এলাকার তরুণদেরও জঙ্গি হতে প্রণোদিত করছে। ম্যানচেস্টারের হামলাকারীও একজন লিবীয় বংশোদ্ভূত তরুণ। সিরিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আসা অনেক তরুণও পা বাড়াচ্ছে জঙ্গিবাদের দিকে। এইসব তরুণদের মগজ ধোলাই করা অনেক সহজ। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তোমার জন্মভূমির বেহাল দশার জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্ব। অতএব স্বর্গে যেতে চাইলে এই বর্তমান সভ্যতাকে ধ্বংস করতে হবে। তোমাকে নাড়া দিতে হবে বিশ্বের ভিত্তিমূলে। এটাই জান্নাতের পথ।
এই বিপথু তরুণরা অকালে জান্নাতের পথে পা বাড়াতে এবং আরও শত শত মানুষের মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে এত ব্যগ্র হতো না যদি তাদের জীবন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে মগজ ধোলাই করে দেওয়া না হতো। ধর্মের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের বুঝানো হচ্ছে ‘ইসলামি বিশ্ব’ গড়ার পথ হলো মানুষকে হত্যা। এটাই নাকি ‘জিহাদ’। বাংলাদেশেও একইভাবে শত শত তরুণকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে জঙ্গিবাদের দিকে। এরাও একই রকম মগজ ধোলাইয়ের শিকার। প্রকৃতপক্ষে এই অবস্থা রুখতে বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে আগে তাকানো দরকার।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সারা বিশ্বেই আদর্শিক সংকট দেখা দেয়। সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় ক্ষমতার ভারসাম্য। সেই শূন্যতার মধ্যেই ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আসর জমিয়ে নেয়। অস্ত্র বিক্রির প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী ছোট ছোট আঞ্চলিক যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ না হলে তো বন্ধ হয়ে যাবে অস্ত্রের উৎপাদন ও রমরমা লাভের ব্যবসা। তাই বিশ্বযুদ্ধ নয়, শুরু হয় আঞ্চলিক যুদ্ধ। আঞ্চলিক যুদ্ধ আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রকট আকার ধারণ করে। সেখানে মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ ও জীবনযাত্রার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। যেখানে জীবনের স্বাভাবিক বিকাশের ধারা রুদ্ধ হয় সেখানেই আসর গেড়ে বসে ধর্মীয় মৌলবাদ। সেখানে নারীর উপর চলে নিপীড়ন। সেখানে চলে ধর্মের অপব্যাখ্যা। সেখানে তরুণদের বিপথগামী করা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিস্থিতি আর ক্ষমতার খেলা গোটা বিশ্বকেই করে তোলে অস্থির।
বিশ্ব থেকে জঙ্গিবাদ দূর করতে হলে প্রথমে বন্ধ করতে হবে আঞ্চলিক যুদ্ধ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে জীবন পদ্ধতি বর্তমান বিশ্বের ভাবধারা ও জ্ঞানবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সেগুলো বাতিল করে আধুনিক শিক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করা হোক। তরুণ প্রজন্মকে ধর্মের মানবিক ব্যাখ্যা শোনানো হোক। ওদের খুনি করে গড়ে তোলা বন্ধ হোক। কারণ একথা অতি স্পষ্ট যে, আইএস নামক সংগঠনটির কর্তা ব্যক্তিরা ধর্মের ধারে কাছেও নেই। তারা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে মগজ ধোলাই করে পরিণত করছে একেকটি কিলিং মেশিনে।
সারা বিশ্বেই এখন প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মকে বেপথু হওয়া থেকে রক্ষা করা। এরা নিজেরাও যেমন মরছে তেমনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। কনসার্টে যে ২২টি প্রাণ ঝরে গেল তারা ধর্মের কাছে, ঈশ্বরের কাছে কি অপরাধ করেছিল? কোন অপরাধই করেনি। আমাদের হলি আর্টিজানে যারা মৃত্যুবরণ করল সেই নিরীহ মানুষরাই বা কি অপরাধ করেছিল?
যারা খুনি তাদের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। কিন্তু তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যারা ওদের খুনি বানাচ্ছে তারা আরও অনেক বড় অপরাধী। ওই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে ধরা দরকার সবচেয়ে আগে। ধর্মের নামে তরুণদের খুনি বানানো বন্ধ হোক। বন্ধ হোক ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর