ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কুরোসাওয়ার অস্কারজয়ী রশোমন বনাম অন্ধ মন

প্রকাশিত: ০৪:১৭ এএম, ৩০ মে ২০১৭

একটি ঘ্টনা ঘটলো ।  উপস্থিত ৪ জন ৪ রকম বর্ণনা দিল। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা উঠে এলোনা।  এলেও রয়ে গেল বিজয়ী -বিজিতের অনেক অধ্যায় গোপন রেখে। ৪ জনের গল্পের কিছু এদিক ওদিক ফাঁক ফোকরে জন্ম নিল পরজীবী গাছ। সেই গাছ আস্তে আস্তে পাঁচিলের পরজীবী গাছের মত গোটা পাঁচিলে ফাটল ধরিয়ে দিল। টিকে থাকলো সেই গল্পটাই যেটা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা গেছে বা ধোপে টিকে গেছে। কারণ ইতিহাস বিজয়ীর পক্ষেই বলে।

গল্পটা বনানীর রেইনট্রি মামলার হতে পারে, এসপি বাবুলের স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের নাটকেও হতে পারে, অন্য অসংখ্য সরল, গরল গল্পের হতে পারে।  বর্ণনায় সরলীকরণে ধার নিচ্ছি অস্কার বিজয়ী আকিরা কুরোসাওয়ার “রশোমন” ছবিটি, যে ছবির মাধ্যমে ১৯৫০সনে জাপানি চলচ্চিত্রের প্রবেশ ঘটে বিশ্ব দরবারে।  গল্পটা ছিল তিনজনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এক অপরাধ, আর ৪ জনের সাক্ষ্য নিয়ে। ঘটনার পাত্র পাত্রী এক দস্যু, এক সামুরাই (জাপানি যোদ্ধা) এবং তার স্ত্রী। গহীন বনে স্ত্রীকে ঘোড়ায় করে আভিজাত্যের পর্দা দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাচ্ছেন সামুরাই। পথিমধ্যে গাছের ছায়ায় জিরোচ্ছিল কুখ্যাত এক দস্যু। তার  কুনজরে পড়ে যায় সামুরাই বধু। কূলবধুর অভিজাত সৌন্দর্য্য এক পলকের জন্য দেখতে পেয়ে দস্যুর মনে হলো যেন স্বর্গের কোন অস্পরা। লম্পট দস্যুর নেশা চেপে গেল, তার স্বামীকে হত্যা করে হলেও তাকে পেতেই হবে।  তাকে সে পেয়েও যায়, কোন রক্তপাত ছাড়াই।  তবুও খুন হন সামুরাই । কেন? 

ঘ্টনার সাক্ষ্য দিলেন লাশ প্রথম যে দেখেছিল সেই কাঠুরিয়া, খুব হবার তিনদিন আগে সামুরাই আর তার স্ত্রীকে দেখতে পাওয়া পাদ্রী, দস্যু নিজে, সামুরাইয়ের স্ত্রী এবং মৃত সামুরাই স্বয়ং, আত্মার ডাকার মাধ্যমে ভর করে।  দস্যু এবং কাঠুরিয়ার দাবি সামুরাই খুন হয়েছেন দস্যুর হাতে। কারণ স্ত্রীর অপবিত্র শরীর দস্যু গ্রহণ করতে পারে, সামুরাই নন। আর এই লজ্জার কথা জেনেছে এমন কেউ জীবিত থাকা তার স্ত্রীর জন্য অবমাননাকর।  কিন্তু মৃত সামুরাই আর তার স্ত্রীর দাবি, আত্মহ্ত্যা করেছিলেন সামুরাই, তার স্ত্রীর ড্রেগার দিয়ে। কারণ হাত পা বাঁধা অবস্থাতে খোলা চোখে সে দেখতে পেয়েছিল দস্যু তার স্ত্রীর চরিত্র হননে উপগত হলে শুরুতে স্ত্রী তাকে প্রতিহত করলেও সহজেই সমর্পিত হয়েছিল। সামুরাই-স্ত্রীর কাছে নিত্যকার প্রহসন আর অসার জীবনের চেয়ে কুখ্যাত ডাকাতের অদম্য বন্যতা শ্রেয়তর এবং পুরুষোচিত মনে  হয়েছিল। আর, অসমাপ্ত গল্পের ইতি টানেন পঞ্চম ব্যক্তি যে প্রবল বর্ষার দিনে রশোমনে আশ্রয় নিতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকে পড়া সেই কাঠুরিয়া আর পাদ্রীর কাছে গল্পটি শোনে। রাশোমন ছিল কিউতো প্রাসাদ অঞ্চলের মূল প্রবেশদ্বার, প্রাচীন বিশ্বাসে যেই দ্বার কোন অমঙ্গল প্রবেশে বাধা দেয়।

সংলাপের বরাতে উঠে আসে অকাট্য বাণীঃ প্রতিটি মানুষ নিজের ব্যক্তি স্বার্থেই কাজ করে যায়; তা সে স্বার্থ যেই মাপেই হোক।  যেই গল্প বলেছে সেই নিজেকে বাঁচিয়ে মিথ্যার সাথে সত্যের জোরালো মিশেল দিয়ে গেছে। এটাই মানুষ চরিত্র।  মানুষ নিজের কাছেই সবসময় সত্যি বলতে পারেনা। মিথ্যা ভুলতে বানানো সত্যি দিয়ে গড়া মেকি গল্প বানায়, বিশ্বাস করতে চায়, সেই গল্পই শোনাতে চায়। একসময়ে সেই গল্পই তার নিজের কাছেও সত্যি মনে হয়।  নারীও চোখের জলে অন্যকে ভোলায়, এমনকি নিজেকেও ভোলায়।  এই দুনিয়ায় সব ভাল বলে কিছুই নেই। যদি কেউ দাবি করে তা মেকি।

রশোমন-এ বিমূর্তরূপে উঠে আসে কামনা বাসনার সরল অংক। একদিকে সামুরাই বধুর নিজের মনের অবদমিত আকাঙ্খা,  অন্যদিকে দস্যুর উদগ্র কামনার অসারতা।  দস্যুর অস্পষ্ট পর্দায় আবৃত রাজসিক পোশাকে সামুরাই বধুর উন্মুক্ত পদযুগল, আধখানা মুখ যখন নজরে আসে, তার কাছে সে অপ্সরা হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু তাকে পাবার পরই তার মনে হয় স্রেফ সাধারণ আর দশটা নারীর মতই এক নারীই মাত্র! কাজেই, প্রাপ্তি দীর্ঘতর করতে তাকে সঙ্গী হিসেবে নিতে সে একবাক্যে অস্বীকার করে। আবেগীয় বা সামাজিক বাঁধনের বাইরে সাময়িক ঝোঁক যত প্রবলই হোক না কেন এই উন্মাদনা ক্ষণস্থায়ী এবং অর্থহীন। সে এই দায় কেন টেনে বেড়াবে? এটাই মানবজীবনের মূল উপপাদ্য।  আজ কিছু ঘটে তো বাদী-বিবাদী যে যার পক্ষ টানেন। মূল ঘটনা একেকবার একের দিকে বাঁক নেয়। একেক মানসিক চরিত্রের নিজস্ব বিশ্বাসের বাতাসে সেই গল্প ব্যক্তির নিজস্ব আদর্শ ও মূল্যবোধ বরাবর পাল তোলে। কথিত আছে, আমাদের জাতীয় বিমানবন্দরে স্মাগল আইটেম ধড়পাকরের অভিজ্ঞতার ওপর বই লিখে বিপুল আলোড়িত লেখক যখন কাস্টমস এ ছিলেন তখনই সর্বাধিক স্মাগল গুডস ধরা পড়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে জনগণের কাছে নায়কোচিত হয়ে জেগে ওঠা এমন সততা দক্ষতার মানদণ্ডের আড়ালে ছিল গল্পের চেয়েও বৃহত্তর অসততার অন্য গল্প। যত বেশি ধড়পাকড়, ততোধিক উদরপূর্তি। 

ঈশপের গল্পে এক হরিণের একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে না পাওয়ায় বিপদের হাত থেকে বাঁচতে সে সমুদ্রের ধারের মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াত। তার ভালো চোখটা সে ফিরিয়ে রাখত ডাঙার দিকে, যাতে কোনো শিকারি বা শিকার ধরা কুকুর এলে দূর থেকেই তাকে দেখা যায়। সমুদ্রের দিক থেকে সে কোনো বিপদের ভয় করত না। একদিন সমুদ্রে সেই এলাকা দিয়ে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল কিছু লোক। তারা হরিণটাকে দেখতে পেয়ে অনায়াসে বন্দুক তাক করে তাকে মেরে ফেলল। গল্পের শিক্ষাটা ছিল যে দিক থেকে সবচেয়ে কম সন্দেহ করা যায়, অনেক সময় সেদিক থেকেই বিপদ ঘনিয়ে আসে।

আমরাও তেমন তাই দেখি, যা দেখানো হয়। যা আলোচিত তাই আলোচনা করি। বন্ধ চোখের অনালোচ্য বিষয়টা দেখতে পাইনা।  আকিরা কুরোসাওয়া ছিলেন মানবতাবাদী নির্মাতা। তার গল্প কাউকে ফেরেশতা দাবি করেনা, কাউকে আদ্যোপান্ত শয়তানও না। আলো-অন্ধকারে থাকা কিছু মরিয়া মানুষের গল্প বলে। মানুষ আর সমাজের ওপর বিশ্বাস হারাতে বসা মানুষের কাছে  আবারও আশায় বাজি ধরার গল্প বলে।  বলে, কোন ঘটনায় কাউকে ফেরেশতা না ভেবে মানুষ ভেবে ষড়রিপু বিবেচনায় রেখে কোনটা সমাজ এবং মানবতার জন্য হুমকিমূলক সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। দেশ-সমাজ ভেদে যেমন অনেক স্বাভাবিক, সরল আচরণও অস্বাভাবিক, গরল ঠেকে  তেমনি একইদেশে গ্রাম, শহর, শ্রেণি, ধর্মভেদে, এমনকি পরিবার ভেদেও তাই। সুতরাং বিবেচ্য হবে সার্বজনীন অপরাধটুকু। আইনও তাই অন্ধ, সে উত্থাপিত প্রমাণাদির উপর রায় দেয়, মনের হদিসে থাকেনা। মনের হদিস বিচার করলে উঠে আসতো অন্ধকার যুগের অন্ধকারে উঠে আসা জেনেটিক ইনফরমেশনে পুরুষের আধিপত্যমূলক মন, যেই মনে সে নারীকে অধিকার করার, ভোগ দখল করার মানসিকতা ধারণ করে, অর্জন করার নয়।

দৈনিক ২ লক্ষ টাকার হাত খরচে বেড়ে ওঠা যুবক চাইলে যে কোন পেশাদার প্রমোদসঙ্গী পেতে পারে, জোরপূর্বক দখল আর ভিডিও ব্ল্যাকমেইলিংএর মাধ্যমে পুনরায় মুফতে দখলদারিত্বের হুঁশিয়ারী সেই লাঠিয়ালী রক্তেরই হুঙ্কার। অর্জুনের মতন ধনুর্বিদ্যার দক্ষতায় কাঙ্খিত নারী অর্জনের অভিপ্রায় নাই। অন্যদিকে নারীর গ্লানি বা প্রতিবাদ এই জন্যে নয় যে সে একগামী বা কেউ ছুঁয়ে দিলে সে পচে গেল। প্রতিবাদ এজন্যই যে নারী পুরুষ উভলিঙ্গিক যে কাউকেই বিনা অনুমতিতে কেউ ছোঁবে এটাই এক তীব্র অপমান, অসন্মান।  আলোচ্য বিষয় আজকে পৃথকভাবে রেইনট্রি মামলা নয়, কি মুখ থুবড়ে পড়া তনু হত্যাকাণ্ড – ত্বকী হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক কিংবা সুন্দরবন হত্যাকাণ্ড নয়- যেকোন অন্যায্যতায় অপরাধ, অন্যায্যটাতা আলোচিত হোক, বিচার হোক এবং তার চেয়েও গুরুতরভাবে -শুদ্ধ হোক।  যেকোন মাধ্যমে ঝড় তুলতে গেলে আরেকবার অন্তত ভাবি। কিছু ঘটলেই নিজে জানার আগেই টেবিলে চাপড়ে অভিমত না জানিয়ে বা জেনেও জ্ঞানপাপের তাড়নায় ভুল জানিয়ে নিজেকে অপরাধী প্রমাণ না করি।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন