মিথিলা-সাফাতরা কেন এমন হয়!
জ্যাকুলিন মিথিলার কথা মনে আছে? মেয়েটি বাংলার সানি লিওন হতে চেয়েছিল। সানি লিওনের বিভিন্ন ছবি থেকে `অনুপ্রাণিত` হয়ে সেই একই ভঙ্গিতে ছবিও তুলেছিল। কিছু সিনেমা আর মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেছে। যার পুরোটাই ছিল বিভিন্ন অশ্লীল ভঙ্গিমায় দেহ প্রদর্শন।
এবছরই ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নিজের ঘরে সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলে মরে গিয়েছে মেয়েটি। সহজ বাংলায় যাকে বলে আত্মহত্যা। মানুষ তো স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে। মিথিলারও স্বপ্ন ছিল সে বাংলার সানি লিওন হবে। সেই পথে এগিয়েও যাচ্ছিল, তবু সে আত্মহত্যা কেন করলো? এর কারণ হচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান। মিথিলা জন্ম নিয়েছিল খুবই দরিদ্র একটি পরিবারে। তাদের দিন কাটতো খেয়ে, না খেয়ে। মেয়েটি রূপবতীও নয়। একে তো গরিব, তার ওপর নেই রূপ। এমন একটি মেয়েকে কে মডেল বানাবে! মিথিলা তখন বেছে নিলো সবচেয়ে সহজ পথ, দেহ প্রদর্শন! এবং সে যা চাইছিল, তাই পেয়ে গেল। রাতারাতি পরিচিতি। টাকা, পাকা বাড়িতে থাকা, বিমানে করে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, ফেসবুকে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার, সবই তার নগ্নতার বিনিময়ে পেয়েছিল।
মেয়েটির আত্মহত্যার পর আমি তার ফেসবুক প্রোফাইলে একবার ঢুকেছিলাম। তার অনেকগুলো পোস্টে দেখেছি শিশুদের ছবি দিয়ে ক্যাপশন লিখেছে- এরকম একটি বাচ্চা হলে আর কিছু চাই না। নিজের নগ্নতার বিনিময়ে পাওয়া পরিচিতিও চায় না সে। শুধু দেবশিশুর মতো একটি শিশু চায়। নিজের ভেতরের মাতৃত্বকে অস্বীকার করতে পারে কোন নারী! মেয়েটি বিয়েও করেছিল। যতদূর জানা যায়, তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মনোমালিন্য থেকেই তার এই আত্মহত্যা!
বাংলাদেশের কারো পরিবারই চাইবে না তাদের ঘরের মেয়েটি বা বউটি এমন হোক। মিথিলা তবু হতে চেয়েছিল। হয়েছিলও কিছুটা। তারপর আত্মহত্যা করেছে। তার এই আত্মহত্যার পেছনে দায়ী তার প্রত্যাশা আর বাস্তবতার সাথে ফারাক। বাস্তবতা কঠিন। সেখানে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। বিনা কষ্টে প্রাপ্ত অর্জন আবার কোনো কারণ ছাড়াই হারিয়ে যাবে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
একজন মডেল কিংবা অভিনেত্রী হতে হলে যে কঠোর অধ্যাবসায় দরকার, মিথিলা তা করেনি। শুধু মিথিলাই নয়, জীবনের নিগূঢ় যে অর্থ তা আর এ প্রজন্মের কজন ছেলেমেয়ে জানে? কজন ভেবে দেখে, পৃথিবীতে তার আসার অর্থটা মূলত কী? কী কাজ আছে তার করণীয়? সমাজব্যবস্থা তো বটেই, এর জন্য দায়ী আমাদের পরিবারও। কয়টি পরিবারে শেখানো হয়, তোমার জীবনটা তোমার একার নয়। পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছ সৃষ্টিকে ভালোবাসার জন্য। এখানে যেটা শেখানো হয়, সেটা হলো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অমুক ফার্স্ট হয়েছে, তোমাকেও হতে হবে। অমুক বিখ্যাত হয়েছে, তোমাকেও হতে হবে। সন্তানকে নিজের দায়িত্ব তাকে নিজেকে নিতে শেখানো হয় না।
দেশের বাইরে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। ইউটিউবের কল্যাণে যতটা দেখেছি, উন্নত বিশ্বের সবগুলো দেশে শিশুকে নিজের হাতে খেতে শেখানো হয়। যেখানে আমাদের দেশের মায়েরা `ওলে ওলে বাবু, খাও নাহয় বাঘ আসবে বলে` শিশুর পেছন পেছন ঘুরে খাবার খাওয়ায়। যার পেছনে নষ্ট করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আজ তাই দরিদ্র পিতার মেয়ে মিথিলার আত্মহত্যা আর শিল্পপতির ছেলে সাফাতের ধর্ষক হয়ে ওঠা একইসূত্রে গাঁথা। এরা দুজনই না চাইতেই, বিনা পরিশ্রমে অনেককিছু পেয়ে গিয়েছে। বাস্তবতা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, সাফল্য- এসব শব্দের মানে এরা জানে না। শিল্পপতির ছেলেটি বাবার টাকা খেয়ালখুশি মতো উড়িয়েছে, দরিদ্র মেয়েটি তার শরীর দেখিয়ে বিনা কষ্টে পরিচিতি পেতে চেয়েছে। কিন্তু অসঙ্গতি ছিল তাদের স্বপ্ন আর বাস্তবতায়। বাস্তব জগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে যে লড়াই জানা দরকার, তা তারা কখনো শেখেনি। তাদের দরকার পড়েনি। কারণ তারা বিনা পরিশ্রমেই অনেককিছু পেয়ে গিয়েছে। আর এই কারণেই হারিয়েও ফেলেছে। একজন আত্মহত্যা করে পরপারে, আরকেজন ধর্ষণ করে জেলে। সচেতনতার সময় কি এখনও আসেনি? নাকি পুরো দেশটাই ধীরে ধীরে জেলখানা হয়ে যাবে!
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম