ধর্ষণের মনগড়া যুক্তি দেখানো নীরব ধর্ষণের শামিল
মাছি মারা কেরানির মত ধর্ষিতাদের রেজিস্ট্রার দেখে আমরা অবিরাম নাম গুনে যাই। এক তনু দুই শিশু সুমাইয়া, তিন শিশু পূজা, চার শিশু আয়েশা, আরো কতো নাম। হযরত আলী আর তার ধর্ষিত শিশুকন্যার আত্মাহুতি আমাদের বিবেককে যখন বাকরুদ্ধ আর হতবিহ্বল করে রেখেছিলো, ঠিক তখনি স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও তার বন্ধুদের দ্বারা দুই ছাত্রী ধর্ষণ এবং তার ভিডিও গ্রহণ সারা দেশব্যাপী ঝড় তুলে দিলো। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ ধর্ষকের পিতা দিলদার সেলিমের সাথে গলা মিলিয়ে প্রচার করে যাচ্ছেন "এটি সমোঝোতায় হয়েছে"। কেউ বলছে অশালীন পোশাক এর অন্যতম কারণ বা "ভদ্র পরিবারের মেয়েরা কখনো হোটেলে যায় না" । আবার কেউ বলছে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আরেক ধরনের মানুষ বলছে রাতে নারীরা রাতে বাইরে বের হলে ধর্ষণতো হবেই। তাদেরকে আমার প্রশ্ন: অশালীন পোশাকই যদি ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে মসজিদের ইমাম সাহেব দুগ্ধ আর বালক শিশুকে কোন কারণে ধর্ষণ করে? একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারেরা আমাদের দেশের নারীদের যখন ধর্ষণ আর নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো তা কি পোশাকের কারণে হয়েছিলো? তনু আর খাদিজা কি হিজাব ব্যবহার করেনি? কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের একজন ডাক্তার হিজাব পরেও কি রক্ষা পেয়েছিলো একজন সাধারণ সিকিউরিটি গার্ডের হাত থেকে? তাই ভাইবোনেরা, বলছিলাম কি ধর্ষণের মনগড়া কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের নারী বিদ্বেষী রূপটি দয়া করে উন্মোচন করবেন না। বাংলাদেশের কিছু মানুষের এসব মনগড়া ব্যাখ্যা শুনলে নিজেদের বড় বেশি হতদরিদ্র মনে হয়। মনে হয় না আমরা কখনো বীরের জাতি ছিলাম। মনে হয় না আমরা নারী-পুরুষ মিলে এই দেশটিকে হানাদার মুক্ত করেছিলাম। মনে হয় না নজরুল, রবী ঠাকুর, লালন, জীবনানন্দ দাশের জীবন দর্শনের প্রভাব নিয়ে আমরা এই বাংলায় বড় হয়েছি।
এরই মধ্যে গণমাধ্যমে স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন সোনা ব্যবসায়ী দিলদার। তিনি অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় বলে দিয়েছেন "জোয়ান বয়সে এমন একটু আধটু সবাই করে। আমিও করেছি " সোনা ব্যবসায়ী দিলদার সেলিমের বক্তব্য শুনে মনে হয় আমরা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অভিনয় দেখছি,অথবা হিন্দি সিরিয়ালের কোনো ক্রাইম সিনের স্মাগলার অথবা নারী পাচারকারী ব্যবসায়ীর হুংকার শুনছি । যারা নারীকে উপভোগ্য বস্তুর চেয়ে বেশি কিছুই ভাবতে পারেনা। একজন বাবার এমন নির্লজ্জ স্বগতোক্তি জাতি হিসেবে আমাদের কলংকিত করেছে। ইতোমধ্যে দু`জন ধর্ষককে পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়েছে। তবে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তারা মনে করছেনা এটি কোন গুরুতর অপরাধ!
এ ঘটনায় আপন জুয়েলার্স বয়কট করার ঘোষণা দিয়ে সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কয়েকজন সেলিব্রেটি অভিনয় শিল্পী। সে ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে রয়েছে দ্বিধা বিভক্তি। অনেকে বলবেন আপন জুয়েলার্সতো কোন দোষ করেনি, কেউ বলবে কতোগুলো লোক চাকরিহারা হবে। আমি বলতে চাই অলংকার মানুষের মৌলিক চাহিদা নয়। " স্বর্ণালংকার ছাড়া নারীর সৌন্দর্য বিকাশ হয় না"- এমন কথায় আমার মতো অনেকেরই হয়তো দ্বিমত থাকতে পারে। আমার মনে হয় কি নারী, কি পুরুষ একজন মানুষের সৌন্দর্য কখনো শুধু স্বর্ণালংকার দ্বারা শোভিত,বর্ধিত হতে পারেনা। মানুষকে সুন্দর করে তাঁর শিক্ষা এবং আত্মবিশ্বাস। স্বর্ণালংকার ব্যবহার নারীকে আরো বেশি নারী করে তোলে, সীমাবদ্ধ করে রাখে আটপৌরে জীবনের চার দেয়ালে।
আমাদের দেশের নারীদের স্বর্ণালংকারের প্রতি এই অবাধ দুর্বলতাকেই দিলদার সেলিমের মতো লোকদের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বানিয়েছে। যার উত্তাপে নর্দমার কীট হয়ে তারা সিংহের মতো হুংকার দেয়। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষ বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে নিজের কন্যা শিশু নিয়ে আত্মাহুতি দেয় ট্রেনের নিচে। তবে সকল দরিদ্র মানুষই কিন্তু হযরত আলী নয়। কেউ কেউ বিচারের আশায় আস্থা হারিয়ে আত্মমর্যাদা রক্ষায় নিজ হাতে তুলে নেয় ধর্ষকের বিষদাঁত। ২০১০ সালে ঝালকাঠির এক দরিদ্র বিধবা নারী ধর্ষকামীর সাথে ভাব জমিয়ে তাকে অচেতন করে পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে তা ওসির টেবিলে জমা দিয়েছিলো। কিন্তু এরুপ প্রতিশোধ সভ্য মানুষ কখনোই চায় না। আর প্রতিশোধ নিয়েও কেউ কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা। একজন পুরুষের একটি অঙ্গ না থাকলে যে ক্ষতি, ধর্ষণের ফলে নারীরও ঠিক একই রকম ক্ষতি। সুতরাং ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার এই বিচার যখন সমান হবে না তখনি দেখা দেবে সামাজিক নৈরাজ্য।
সমাজবিজ্ঞানিরা মনে করেন ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। তাঁদের মতে এর কারণ শুধুই শারীরিক নয়। আর নারীবাদীরা মনে করেন ধর্ষণ নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। একজন নারীবাদী অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবে বলেছিলেন, `` পিতৃতন্ত্র হলো ধর্ষণবাদের ধর্ম ``। এই একবিংশ শতকেও আমাদের সমাজ পুরুষকে দেখে মুগ্ধ চোখে, আর নারীকে উপভোগ্য পণ্য হিসেবে। এই মনস্তত্ত্ব শুধু পুরুষরাই নারীদের সম্পর্কে পোষণ করেনা, করে নারীরাও। সে সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। নারী-পুরুষের প্রতি এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গড়ে উঠেছে এক নিকৃষ্ট মনস্তত্ত্ব যা উৎসাহিত করছে ধর্ষণকে। তাই সারা দেশ এখন ধর্ষকাম রোগে আক্রান্ত। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো ধর্ষণ মোকাবেলার জন্যে এখন প্রয়োজন একটি ধর্ষণ পূর্বাভাস প্রযুক্তি, যেখানে আমাদের এই ভুখণ্ডে, সম্ভবত, সবসময় দশ নম্বর বিপদ সংকেত জ্বালিয়ে রাখতে হবে ।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর