নারীর শাশ্বত রূপ : স্নেহময়ী, মমতাময়ী মাতৃত্ব
পৃথিবীর সকল মায়েদের জন্য আজ মা দিবসের অনেক শুভেচ্ছা রইলো। মা শব্দটা যেমন কঠিন দায়িত্বভার বহন করছে, তেমনি সুখকর আর উপভোগ্য এই মাতৃত্ব। জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করাই আমাদের সবার জীবনের মূল লক্ষ্য। একজন নারী, এবং একজন মা হিসেবে আমি মাতৃত্বকেই সবচাইতে বেশি উপভোগ করেছি। জীবনের প্রতি সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি আমার পাল্টে গেছে মা হয়ে। পরিপূর্ণ মাতৃত্ব থেকে প্রাজ্ঞতার যে আভাস একজন নারী পায়, তা অনুধাবন করতে পারলে তাঁর পথ সে নিজেই খুঁজে পাবে একদিন। মহাত্মা গান্ধী যখন অনশনে ছিলেন তখন আত্মশক্তির জন্য বারবার একটা কথা বলতেন, "মাই লর্ড, মেইক মি মোর ওম্যানলি।"
নারীর ক্ষমতা যে কতো ঐশ্বরিক এই বাণীতে তার আভাস আছে। তবে সমস্যা হলো, আধুনিক নারী মা হওয়াকেই জীবনের ইতি ভাবে। তাই তাদের পুরুষের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হয়। পৃথিবীব্যাপী আধুনিক নারী, এমনকি প্রাচ্য নারী, যারা কিনা ছিলো মাতৃত্বের কর্ণধার, তারাও আজ নিজেদের মা বলে, গৃহিণী বলে পরিচয় দিতে লজ্জিতবোধ করে, হীনম্মমন্যতায় ভোগে। অথচ মানব সভ্যতায় সবচেয়ে গুরুত্ববাহী ভূমিকা যদি কেউ রাখতেই পারে, তা একজন নারীর পরিপূর্ণ মাতৃত্বের দ্বারাই সম্ভব। একজন নারীই পারে একটি জাতিকে সম্পূর্ণ সুখী, সুস্থ, শিক্ষিত একটি আগামী প্রজন্ম উপহার দিতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সভ্যতার নামে আজ আধুনিকা নারীকে স্বাধীনতার বিভ্রান্তিকর পথে ঠেলে দিয়ে ঘর, স্বামী, সন্তান, সংসার সবকিছু থেকে বঞ্চিত করছে। যা কিনা নিঃশর্তে একজন নারী এবং তার সন্তানদের স্বাভাবিক সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা ছিলো অনাদিকাল ধরে। যে কোন নারীর পক্ষে মাতৃত্বের অন্তঃর্নিহিত ভাবটি অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। নারীর জীবনে দুঃখ আছে, সীমাবদ্ধতা আছে এ কথা ঠিক, তবে তার মাঝে মাতৃত্বের বিশালত্বের আভাসও আছে।
নারী যে সমগ্র সৃষ্টির উৎস সে কথা আছে। কাব্যিক ভাবে, আধ্যাত্মিকভাবে দেখলে মনে হবে নারীর সমতুল্য যদি কেউ থাকে সে কেবল ঈশ্বর। তাই নারীর পিছিয়ে পড়ার জন্য শুধু পুরুষ দায়ী এটা একতরফা ঠিক নয়। মাতৃত্বের কারণেই নারীর দায়িত্বভার সংসারে বেশি। আমি নিজে একজন নারী, নারীকে দুর্বল আমি কোনোদিন ভাবি না। তবে তাঁর দায়বদ্ধতাকে আমি অস্বীকার করিনা। একজন শক্তিশালী মানুষ কেবল নিজের শক্তিকেই অনুধাবন করেন না, নিজের দুর্বলতাকেও অনুধাবন করেন। মনে পড়ছে, আমাদের ডিগ্রিতে ফাইন্যান্স বিভাগে একজন অধ্যাপিকা ছিলেন। ডক্টর লুসিয়া, এক স্পেনিশ রমণী। ঊনত্রিশ বছর বয়স, বিবাহিতা। যেমন ছিলো ওঁর দৃষ্টিকাড়া শারীরিক গড়ন, তেমনি কড়া ছিলো ওর মেধা আর মেজাজ।
যেদিন প্রথম কিছু সমস্যা নিয়ে লুসিয়ার অফিসে গেলাম সেদিন লুসিয়ার ঝলমলে চোখ মুখ দেখে বুঝেছিলাম তরুণ ছাত্রদের দমাতে কড়া মেজাজটা ছিলো লুসিয়ার আত্মরক্ষার কবজ। মেজাজ যতটা নয়, অনেকখানি অভিনয়। সাদা শার্টের সাথে মিনিস্কার্ট, নি হাই লেদার বুট, কোমরে মোটা বেল্ট, চোখে চশমা, কোকড়া চুল কানের দুপাশে, আর জিরো প্রসাধনী। এমনকি একফোঁটা কাজলও ব্যবহার করতো না। লুসিয়াকে দেখতাম আর অনুভব করতাম মাথায় ঘিলু থাকলে সৌন্দর্য বর্ধনে প্রসাধনীর ভূমিকা যে কতো করুণ!! হাতে কিছু লেকচার স্ক্রিপ্ট, কয়েকটা মার্কার আর ডাস্টার নিয়ে ঝড়ের মতো ক্লাসে এসে উপস্থিত হতো। লুসিয়ার ক্লাসে অমনোযোগী হওয়া কারো পক্ষে অসম্ভব ছিলো। কারণ এসেই ও বলতো যাদের ক্লাসে মন নেই ক্লাস শুরু করার আগে ক্লাসঘর ত্যাগ করতে। ক্লাস শেষে কিছু প্রবলেম সলভ করতে হতো সবার। ওর একটাই কথা, আমি সলুশান দেই না, বরং সলুশান যাতে নিজে বের করতে পারো সেজন্য তোমাদের তৈরি করছি। লুসিয়ার পড়ানোর ধরন অন্য কোন ল্যাকচারারের মতো ছিলো না। আমরা সবাই উচ্ছ্বাসের সাথে অপেক্ষা করে থাকতাম ওর ক্লাসের জন্য আর আশা করতাম লুসিয়াকে যেন আমারা ফাইনাল ইয়ারে পাই।
যাই হোক, আমরা ফাইনাল ইয়ারের টাইম টেবল দেখে মহাখুশি, লুসিয়াই ফাইন্যান্স ক্লাস নিবে। আমি আর কি বলি এই স্ত্রীজাতির কথা! লুসিয়া এসে ক্লাসে ঢুকলো, সে এক অন্য লুসিয়াকে আমরা ফিরে পেলাম। লুসিয়া তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রায়ই ওকে লেকচার বাতিল করতে হতো অসুস্থতার কারণে। আমাদের যখন ফাইলাল পরীক্ষা চলবে তখন লুসিয়া থাকবে মেটারনিটি লিভে। লুসিয়া প্রতিদিন তাড়াহুড়ো করে লেকচার শেষ করে দিতে পারলেই বাঁচে। যেসব প্রবলেম আমরা ক্লাসে বসে সলভ না করে ক্লাস থেকে বেরোতে পারতাম না, ওগুলো হয়ে উঠলো হোম ওয়ার্ক। হোম ওয়ার্ক কারেকশন করতে ওকে পরের লেকচারে পাওয়া যেতো না। যেদিন পাওয়া যেতো বলতো আমি সলুশান ইমেইল করবো, দেখে নিও। ওকে দেখতাম আর মেলাবার চেষ্টা করতাম দুবছর আগের লুসিয়ার সাথে।
মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো চিন্তার ব্যাঘাত। একদিন আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিচ থেকে ওকে দেখছিলাম। এক হাতে আলতো করে ওর পেট ধরা, আরেক হাতে সিঁড়ির হাতলে ভর করে আস্তে আস্তে নেমে আসছে সেই ঝড়বেগী লুসিয়া। জিন্সের প্যান্টের সাথে একটা মেটারনিটি ডিজাইন্ড ড্রেস পরা। পায়ে ফ্ল্যাট শু, মুখে প্রেগন্যান্সি রেশ। আমি দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, যে দেহের মধ্যে আস্ত আরেকটা জীবনের সৃষ্টি হয়, দশমাস ধরে সে জীবনের লালন হয়, সেই দেহেরকি শ্রীবৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিলনা? সেই দেহে কি অতিরিক্ত শক্তির সঞ্চালন হওয়া উচিৎ ছিলো না? সে মস্তিষ্কের কি চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিলো না?
নিশ্চয়ই উচিত ছিলো। কিন্তু তা নিশচই হয় না। যদি তাই হতো আজকের এই একুশ শতকের নারী পুরুষের চাইতে শতগুণে বেশি এগিয়ে থাকবার কথা ছিল। অথচ যে নারীর গর্ভে এই সৃজনশীল মনুষ্য জাতির লালন হয়, তাঁর অধিকার আজ সামাজিক সংকটের শীর্ষ তালিকায় স্থান পায়। নিজেকে একসময় বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করতাম, এই দায়ের কিছুই কি পুরুষের নয়? কিন্তু আজ যখন পিছনে ফিরে তাকাই আর মাতৃত্বের দৃষ্টি দিয়ে সেইদিনের লুসিয়ার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার দৃশ্যপট স্মরণ করি তখন কেবলই মনে হয়, নারীর এ দায় যতখানি না পুরুষের, তার চাইতে অনেকখানি তাঁর স্নেহময়ী, মমতাময়ী মাতৃত্বের।
লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
এইচআর/পিআর