ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমাদের কাছে উৎপীড়নের মানে কি এবং কেন?

প্রকাশিত: ০৪:১৩ এএম, ১৪ মে ২০১৭

সাম্প্রতিক দুটি ঘ্টনা, রেইনট্রি হোটেলে আক্রান্ত দুই তরুণী এবং ৮ বছর বয়সী আয়েশার বাবার কন্যা আয়শাকে নিয়ে রেললাইনে আত্মহত্যা- দুটি ঘটনার কার্যকারণই অভিন্ন। বৃহত্তর ক্যাটাগরিতে উৎপীড়ন, ইংরেজিতে বুলি (Bully)। শুনতে হালকা শোনাবে কারণ খুব পরিচিত এই শব্দের ভাবার্থটা আমাদের দেশে ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। 

কেন দুনিয়ার অন্যত্রের চেয়ে আমাদের দেশে এর অর্থ বা প্রয়োগ ভিন্ন তা বুঝতে হলে জানতে হবে,  ১।  কেন আমাদের দেশে উৎপীড়ন ঘটে,  ২। আমাদের সংস্কৃতিতে উৎপীড়নের মানে কি,  ৩। এর প্রতিরোধ ব্যাবস্থা দেশে কি বিদ্যমান এবং  ৪। কোন প্রতিকার বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকলে কি করে উৎপীড়ন আমাদের দেশে মোকাবেলা করা যায়।  

উৎপীড়নের প্রকার : আমাদের দেশে উৎপীড়নের সংজ্ঞা হলো পুরুষ বা উঠতি বয়সী ছেলের কোন তরুণী , নারী বা টিনেইজ মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা। এসব নারী বা মেয়েরা পথে ঘাটে যেকোন স্থানে যেতে আসতে অসভ্য মৈখিক উৎপীড়ন থেকে শুরু করে ভয়াবহ যৌন নিপীড়ন, এমনকি হত্যার শিকারও হন ।

উল্লেখ্য , শুধু শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত না, উৎপীড়নে অন্তর্ভুক্ত নিম্নলিখিত সকল আচরণসমূহ :  
একা বা দলবেঁধে কাউকে বাজে নামে ডাকা, অবমাননা বা হেয় করে কথা বলা , নোংরা চোখে তাকানো , অনুসরণ করা, উস্কানিমূলক কথা বলা, এবং এসব থেকেই শুরু হয়ে তা শারীরিক উৎপীড়নে রূপ নেয়।

আপত্তিকর মোবাইল মেসেজ, চিঠি।  গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিওর হুমকি। চ্যাট রুমে মেয়েদের ভিক্টিমাইজ করা। “International Journal of Social Science” এর গবেষণায় উঠে এসেছে  বাংলাদেশে ১০  থেকে ১৮ বছরের ভেতর ৯০% মেয়েই উপরে উল্লেখিত কোন না কোন উৎপীড়নের শিকার।   শারীরিক উৎপীড়নের শিকার না হলেও উল্লেখিত যে কোন ঘটনাতেই অভিভাবকদের যথেষ্টই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কারণ দীর্ঘকালীন এসব উৎপীড়ন চরম মানসিক চাপের সৃষ্টি করে যা আত্মহত্যায় রূপ নিতেই পারে।

উল্লেখ্য, ননবুলিং ডট কমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১১ সালে ১৮জন নারী  উৎপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন, ৭ জন চেষ্টা চালান।   বলা বাহুল্য, এসব উৎপীড়নের মূলে আছে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক শিক্ষা বা গ্রুমিং।  আমাদের ছেলেরা আজন্ম বেড়েই ওঠে মেয়েদের সেক্সুয়াল অবজেক্ট জেনে, তাদের প্রতি ঘরে বাইরে সর্বত্র অসন্মান দেখেই। তারই এই ফলাফল। আশার বিষয় মেয়েরা এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে , সোচ্চার হতে আরম্ভ করেছে এবং ২০১০ থেকে সরকারের প্রতি মেয়েরা তাদের প্রতিরক্ষার দিকে নজর ফেরাতে জোর দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু, এইসব দাবির কোন পদক্ষেপ  বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান না হওয়ায়  সন্ত্রাস উল্টো বেড়েই চলেছে। যারা সোচ্চার হয়েছেন তারা উল্টো আক্রান্ত হয়েছেন, খুন হয়েছেন। স্মরণ করছি প্রতিবাদী মায়ের উপর মোটর বাইক চালিয়ে খুনের ঘটনা এবং ছাত্রীর ওপর নিপীড়নে প্রতিবাদ করায় কলেজ শিক্ষক হত্যা।

জিরো টলারেন্স শাস্তি হওয়া উচিত এমন একটি বিষয়ে যেহেতু এখনো প্রতিরোধক কোন আইন হয়নি, বা প্রয়োগ নেই, তাই ঘরে, বাইরে, স্কুলে, রাস্তাঘাটে, অফিসে সর্বত্র এই নিপীড়ন চলেই আসছে। এবং এশিয়ার যে কোন দেশের স্কুলে তা এতো এলার্মিং ভাবে যৌন নির্যাতনে রূপ নেয়নি যা এদেশে নিয়েছে।  তাই শুরু থেকেই নারীকে, বিশেষত তার পরিবারকে মানইজ্জতের জুজুর ভয় থেকে বেরিয়ে সোচ্চার হতে হবে এবং অপরাধিকে আইনের আওতায় নিতে হবে। আর সব অপরাধের মতই সমাজের দৃষ্টিতে অপরাধী ঘৃণিত হতে হবে, ভিকটিম কিছুতেই নয়।  কারণ এই উপদ্রপের কারণে মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পায়, বাবা মাও পাঠাতে ভয় পান; ফলশ্রুতিতে বিশেষত পল্লী অঞ্চলে প্রতিবছর স্কুল থেকে ড্রপ আউটের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে বাবা মা অপ্রাপ্তবয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এই নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে চান।

আজকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সোচ্চার হচ্ছে অনেকেই, কিন্তু কেন বাবা- মা এই পদক্ষেপ বেছে নিচ্ছেন তা মূলোৎপাটন না হলে এই মেয়েটিই যখন এধরনের কোন উৎপীড়নের শিকার হবে তখন তারা সেভাবে সোচ্চার হতে পারবে কিনা বা আইনের আওতায় সেই উৎপীড়ককে আনতে পারবে কিনা তাও আগে ভাবা উচিৎ।

যে কারণে বাংলাদেশের নারীদের প্রতি পুরুষদের এমন দৃষ্টিভঙ্গি:  
১। সামাজিক বিধিনিষেধ মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় এবং সম্পত্তিতে, কাজের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ করে রাখে।  ২। নারী তাদের সমগ্র জীবনের জন্য পুরুষদের উপর নির্ভরশীল। প্রথমত, তাদের বাবার ওপর, তারপর স্বামী এবং শেষপর্যন্ত পুত্রের দ্বারস্থ। ৩। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের যত দ্রুত সম্ভব পাত্রস্থ করা হয় যেন তার ভরণপোষণ স্বামীর হাতে ন্যস্ত হয়ে বাবা নিস্তার পান।   ৪। যৌতুকের অভিশাপ, বিশেষ করে দরিদ্র বাবা মার ওপর যা মারাত্মক জুলুম।  ৫। খুব ব্যাপকভাবে কন্যা শিশু বা ভ্রূণ হত্যা রিপোর্টেড না হলেও কন্যা শিশু জন্ম দেবার কারণে মা`র প্রতি লাঞ্ছনা এখনো বিদ্যামান । 

উপযুক্ত আইনের অনুপস্থিতিতেও যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলি নেয়া হয়েছে তা হলো:   
মীনা কার্টুন: কাঁচায় বাস নোয়াতে হয়। সেই আদর্শের খুব উপযোগী একটা উদ্যোগ ছিল ইউনিসেফের আয়োজিত মীনা কার্টুন যেখানে ৯ বছরের বালিকা মীনার যাপিত জীবনের গল্পে সরলভাবে উঠে এসেছে মেয়েদের শিক্ষা, সুবিধার প্রতিবন্ধকতা , বাল্যবিবাহ, নিপীড়ন, এমনকি ঘরের কাজ বা আহার বন্টনেও বৈষম্য। মীনা তার আশেপাশের শিশুদের বার বার করে প্রশ্ন করে তাদের মুখ থেকে উচ্চারণ করিয়ে এসবের অন্ধকার দিক আলোকপাত করেছে এবং তুলে ধরেছে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কি করতে হবে। ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশনঃ বাংলাদেশের ক্লাসরুমে আয়োজিত কর্মশালাটিতে সবার জন্য উন্মুক্ত সেশনে কথোপকথন, মত বিনিময় এবং সরাসরি আলাপচারতায় উৎপীড়ন সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন উত্তর উঠে এসেছে। সেশনে বিভিন্ন স্কুলের ছয় থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।

ক্যারাতে প্রশিক্ষণ: নর্দার্ন বাংলাদেশের উদ্যোগে এই প্রশিক্ষণ মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য খুবই উপযোগী। বাংলাদেশ পুলিশও এখন হটলাইন চালু করেছে যেখানে মেয়েরা কোন উৎপীড়নের জন্য প্রতিকার চাইতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার মেয়েদের খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্পটে পুলিশ নিয়োগ করার কর্মসূচি নিয়েছেন এসব ভোগান্তি থেকে মেয়েদের নিরসনে।

পরিশিষ্ট:  লেখাটা উৎপীড়ন নিয়ে। তাই ছেলে শিশুদের উপর উৎপীড়নও এর অন্তর্ভুক্ত।  শিক্ষার নামে মাদ্রাসা মোক্তবে বিশেষত যেসব শিশু আবাসিক ব্যবস্থায় থাকে তাদের ওপর যৌন উৎপীড়নের ভয়াবহতা আমরা জানি। বহুল উল্লেখিত এই নিপীড়নটা দক্ষিণ কোরিয়ার বছরের সেরা স্কুল হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত মূক ও বধির স্কুলে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের বরাত দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। কোন প্রতিকার হয়নি প্রাথমিকভাবে, আইন শৃঙ্খলা সব টাকার মুখে বিকারহীন ছিল। কিন্তু, এরপরই নির্মিত হয়েছিল এক চলচ্চিত্র, "The Crucible Silenced", গোটা দেশ ফুঁসে উঠেছিল এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উন্মোচিত সত্যে এবং এই মানব দাবানল কোরিয়ার তৎকালীন আইন পাল্টাতে বাধ্য করেছিল।  আর উপমহাদেশের ম্যুভি আইকন ভারতে নির্মিত “পিংক” দেখে আমাদের জনতা যেন নিপীড়নের নতুন দীক্ষা পেল! শেইম!!  

সাম্প্রতিক তনু হত্যাকাণ্ডে খন বিশাল জনরোষ তৈরি হয়েছিল তখন ভাবা হয়েছিল যেই জড়িত থাক, সবাইকে স্বাভাবিক নিয়মেই আইনের আওতায় নেয়া হবে। কিন্তু হয়নি। এবং এই নির্লজ্জ বিচারহীনতা এমন লক্ষ লক্ষ গোপন অপরাধী এবং অপরাধকে সরাসরি প্রশ্রয় এবং উস্কানি দেয়, বলাই বাহুল্য!    সাম্প্রতিক আয়েশার বাবার কন্যাসহ রেললাইনে ঝাঁপ দেয়ার মাধ্যমে শিশুকন্যা নিপীড়ন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে তা হল নির্লজ্জ বিচারহীনতার এক জীবন্ত নথিপত্র!   হতাশাজনকভাবে সুস্পষ্ট যে একেকটি মেয়ে আমার দেশে শিশুবেলা থেকেই বিভিন্নভাবে অসভ্যতা, বর্বরতার শিকার হয়!  আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে বাগানের বদলে নরক তৈরি করে দিয়েছি। জাহান্নামের আগুন না, দুনিয়ার আগুনেই সে যেন পুড়ে যায়।  এই আগুন নেভানোর জিরো টলারেন্স উদ্যোগ না নেয়া অবধি আমাদের মত দেশে মা দিবস, মেয়ে দিবস, ভালবাসা দিবস সবচেয়ে বড় কর্পোরেট ভন্ডামি। একটা দিবস হলেও হোক “মেয়েদের ঘরে বাইরে নিরাপত্তা দিবস”। 

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন