ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধর্ষিতার চোখের জল এবং অন্তরের দীর্ঘশ্বাস

প্রকাশিত: ০৪:২৭ এএম, ১১ মে ২০১৭

ধর্ষণ এমন এক প্রকার সন্ত্রাস যেটা মানবিকতাকে ছিন্নভিন্ন করে আত্মজৈবিক সুখ লাভ করার অভিপ্রায়ে ধর্ষক কর্তৃক সংগঠিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু যুবতী মেয়ে নয়; কোলের ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধা- যে কোন বয়সের নারী্ই এমন নৃশংস দুর্বৃত্তপনার শিকার হতে পারে। মূলতঃ এর পেছনে থাকে অসৎ উদ্দেশ্য, জিঘাংসা বা অন্য কোন ক্রিমিনাল মনস্তত্ব। উপরন্তু ধর্ষক চায় যেন তাকে আইনগত কোন প্রকার ঝামেলায় না পড়তে হয় সেজন্য ধর্ষিতা এবং তার পরিবারের উপর অনৈতিক চাপ প্রয়োগ থেকে শুরু করে জীবনে মেরে ফেলার হুমকিও দিতে সে বা তার চ্যালারা  বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। অনেক সময় ধর্ষিতার পরিবার যদি আর্থিকভাবে দুর্বল হয় তাহলে  টাকা দিয়ে  মিটমাট করে ফেলার প্রলোভন দেখানোর মতো নির্লজ্জ  দাম্ভিকতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রভাবশালীমহলকে ম্যানেজ করে পার পেয়ে যাওয়ার উদগ্র চেষ্টার এক দাম্ভিক প্রদর্শনীও দেখা যায় কখনও সখনো।

এর ফলে অনেক সময় দেখা যায় যে, ধর্ষিতার পক্ষ থেকে মামলা করতে বিলম্ব হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়েও দেখা যায়  যে ডাক্তারি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল লাভ হয় না। সে প্রেক্ষিতে আপামর জনতাসহ অনেক বিদগ্ধজনও  তখন ধরে নেন যে, যেহেতু ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত সেভাবে পাওয়া যায়নি সেহেতু আসামিরা নিশ্চিন্তে খালাস পেয়ে যাবে। তার উপরে আমাদের দেশে বিচারহীনতা নামক এক আজব  অপসংস্কৃতির যে দাপট দৃশ্যমান হয় তা বিবেচনায় নিলে এমন মনে হওয়াটা যে খুব দোষের সেটাও হলফ করে বলা যায় না।

কিন্তু মনে রাখতে হবে ( ভুলটা মূলত এখানেই হচ্ছে বলে আমার মনে হয়) যে, ধর্ষিতার শারীরিক এবং এ সংক্রান্ত পরীক্ষা শেষে যদি ধর্ষণের আলামত মিলেও যায় তবুও কিন্তু  চিকিৎসক কখনো সরাসরি লিখেন না যে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে! আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা  এবং সব কিছু বিবেচনায় নিয়েও যদি চিকিৎসক দেখেন যে, প্রাপ্ত ফলাফল ধর্ষণের  আলামতকে জোরদারভাবে ফুটিয়ে তুলছে না তবুও উক্ত চিকিৎসক  লিখেন না যে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়নি। সারাবিশ্বব্যাপী এটাই প্রাকটিস হয়ে থাকে যা আইনসিদ্ধও বটে। আমাদের দেশেও তেমনটিই হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম কিছু হয় না।

কারণ, আইনে বলা হয়ে থাকে যে, যদি কোন পুরুষের যৌনাঙ্গ  নারীর যৌনাঙ্গকে শুধুমাত্র স্পর্শ করেছে ( নারীর যৌনাঙ্গে  প্রবেশ করানোর বিন্দুমাত্র  আবশ্যকতা কিন্তু এখানে নেই) তাহলেও তা ধর্ষণের সমতুল্য। এখন  তাহলে বলুন তো, এমন ক্ষেত্রে চিকিৎসক কি উক্ত নারীর শরীর পরীক্ষা বা অন্য কোন টেস্ট করেও কি বিন্দুমাত্র ধর্ষণের কোন আলামত পাবেন? উত্তর হচ্ছে, পাবেন না। তাহলে সেক্ষেত্রে কি হবে? মেয়েটি কি আইনের কোন প্রতিকার পাবেন না? উত্তর হচ্ছে , অবশ্যই পাবেন। ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত, ঘটনার পরম্পরা, পারিপার্শ্বিকতা, অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি  সন্তুষ্ট হন তাহলে সে সমস্ত তথ্য এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে অনায়াসেই অভিযুক্ত ধর্ষক নামক পাষণ্ডকে আদালতে দোষী প্রমাণ করে শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন কোন কাজ নয়।

এ কথাগুলো স্মরণে রেখেই ২৮ মার্চ হোটেল রেইনট্রি তে ধর্ষণের শিকার দু’জন মেয়ে ৬ মে ( ঘটনার প্রায় ৩৯ দিন পর) ৫ জনকে দায়ী করে থানায় যে মামলা করেছেন সেটার বিশ্লেষণ করা এবং সে তথ্যাবলীর সত্যাসত্য নির্ণয় করা তাই ভীষণ জরুরি। কারণ তারা অভিযোগ করছেন যে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে, জোর করে, আটক রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেটার ভিডিও নাকি করা হয়েছে! তাদেরকে হুমকি ধামকি দেয়া হয়েছে মামলা না করার জন্য। যে কারণে তারা মামলা করতে দেরি করেছেন। মামলা করতে দেরি হলে  ফৌজদারি অপরাধ তামাদি হয়ে যায় কি?

ফলে হতাশ হয়ে যারা বলছেন যে ঘটনার এতদিন পরে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ায় সে অর্থে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যাবে না এবং ফলত   ন্যায় বিচারও পাওয়া যাবে না-তাদের ধারণা আংশিক সঠিকমাত্র। কারণ, এখানে “রিসেন্ট ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স” এর চিহ্ন পাওয়া যাবে না-এটা সত্যি। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় যৌনক্রিয়া হয়ে থাকলে ( সেটা জোর করে, ফুসলিয়ে, ভয় দেখিয়ে বা যেমন করেই হোক না কেন) যৌনাঙ্গের প্রাপ্ত ফল তো যৌনক্রিয়ার ইঙ্গিতই দিবে। নাকি তাও দিবে না? এখন সে যৌনক্রিয়া, অভিযোগ মতে, যদি ধর্ষণের ফলে হয়ে থাকে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব পুলিশ এবং আইনজীবীদের। এটা মনে রাখতে হবে। সব ধরনের ধর্ষণ কেসের ( সেটা সদ্য বা দেরিতে এ পরীক্ষা সম্পন্ন হোক না কেন) ক্ষেত্রেই কিন্তু সেটাই নিয়ম।

তাহলে শেষমেষ কি দাঁড়ালো?  এটা একদম পরিষ্কার যে, অভিযোগকারী যদি সেদিন ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে ডাক্তারি পরীক্ষায় যৌনক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবেই। এছাড়াও ধর্ষিতার সেদিনের পরনের পোশাক যদি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় এবং সেখানে প্রাপ্ত ডিএনএ এর নমুনা যদি অভিযুক্তদের এক বা একাধিকজনের সাথে মিলে যায় তাহলে তো বিষয়টা আরো জলবৎ তরলং হয়ে যাবে। সে অবধি অপেক্ষা তো  করতেই হবে।  মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ প্রমাণে কোনরকম সরল রৈখিক চিন্তা একদম করা ঠিক  না। (বিশেষ করে যেখানে ঘটনার অনেক পরে মামলা ও শারীরিক পরীক্ষা  সম্পন্ন হয়)। এটা শুধু আমাদের এখানে বলে নয়; বিশ্বব্যাপী এটাই নিয়ম।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, ভারত , শ্রীলংকাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটার এক মাস পরেও শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার রেকর্ড আছে। শ্রীলংকা জার্নাল অব ফরেনসিক মেডিসিন এন্ড ল, মে-২০১৫ তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৮% ধর্ষিতা নারীর শারীরিক পরীক্ষা ঘটনা ঘটার ১ মাস পরে সম্পন্ন হয়েছে। প্রফেশনাল মেডিকেল জার্নাল, ২০১৪  তে প্রকাশিত প্রতিবেদন উল্লেখ করছে যে, পাকিস্তানের লাহোর এবং মুলতানে ২০১৩ সালে সংগঠিত ধর্ষণের ১৭.৫% ঘটনা ঘটার ১ মাস পরে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সে তুলনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত তথ্য  যা ২০১১ সালে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়; সে প্রতিবেদন মতে মাত্র ০.৪৩% ( ১ শতাংশের অর্ধেকেরও কম!!) ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং রেইনট্রি হোটেলে সংগঠিত ধর্ষণের ঘটনায় ১ মাস পরে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও প্রাপ্ত তথ্য তেমন কোন কাজে আসবে না বলে যারা মনে করছেন তারা অর্ধ সত্য নিয়ে আছেন।  সে কথা  তো আগেই বলেছি।

এমন ঘটনায় তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি ধর্ষিতা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে পূর্ণ জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাহলেই বিষয়টা আরো অধিকতর পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঘটনার পারিপার্শ্বিকতাসহ যদি সিসিটিভি ফুটেজ এবং সেদিন যেহেতু ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়েছে বলে ধর্ষিতা অভিযোগ করেছেন সেটা খুঁজে বের করাও  তাই খুব দরকার। ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি এগুলোও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে না থেকে ফৌজদারি অপরাধে ঘটনার স্থল ( scene of crime) এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা (circumstantial evidence) বিবেচনায় নেয়াও কিন্তু অত্যন্ত জরুরি। এটা ভুলে গেলে চলবে না।

তাই, সার্বিক  অবস্থা বিবেচনায় নিলে একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এমন জঘন্য ঘটনা ঘটে যাওয়ার যতদিন পরেই মামলা হোক না কেন তাতে ঘটনার ভয়াবহতার বিন্দুমাত্র রকমফের হয়নি। সেক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল, ডিএনএ রিপোর্ট  এবং সেই সাথে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার নিবিড় তদন্তের ফলাফল সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় যে, অভিযুক্তরা যতই সমাজের প্রতিপত্তিশালী মানুষ হোক না কেন; এমন অনৈতিক, সন্ত্রাসী কাজ ঘটানোর পরেও তারা পার পেয়ে যাবে তা বিশ্বাস করতে কেন যেন মন সায় দেয় না। কারণ, পাপ কখনো ঢেকে রাখা যায় না! পাপের প্রায়শ্চিত্ত শেষ অবধি পাপীকে করতেই হয়। সেদিন অবধি অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে এমন ঘটনার পরে  দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব মামলা (বিশেষ করে কথিত প্রভাবশালী বলে যারা পরিচিত তাদের বিরুদ্ধে মামলা) নিস্পত্তি করে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া গেলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে-সে কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন