ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কঠিন লড়াই সামনে- জয় হোক মেয়ে!

প্রকাশিত: ০৩:৫৭ এএম, ১০ মে ২০১৭

ধর্ষকামী পুরুষ কি কখনো শুধরে যায়? এরা কি কখনও ধর্ষণের চিন্তা বাদ দিয়ে সাধু পুরুষ বনে যেতে পারে?

সহজ উত্তর- না। যার মগজের ভেতরে ধর্ষণপ্রবৃত্তি আছে, সে তা থেকে এ জীবনেও বের হতে পারে না স্বেচ্ছায়। যে লোকের মস্তিষ্ক আর রক্তের মধ্যে বিকৃতি আর ধর্ষণের ইচ্ছা ঢুকে গেছে, সে কখনোই তা ভুলে সুস্থ সুন্দর চিন্তা করতে পারে না। তবে? তবে সমাজ আর রাষ্ট্র এই ধর্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? উত্তর একটিই। আইন দিয়ে। কঠোর শাস্তির বিধান আর উদাহরণ সৃষ্টিই এইসব কামুক শয়তানদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে। আর কোনভাবেই ধর্ষণের এই মহামারী থেকে উদ্ধার পাবার কোন উপায় নাই। এটি খুব সোজা এবং সহজ একটি হিসাব।

সমাজে যে লোকগুলো মনের ভেতরে ধর্ষণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সুযোগের সন্ধানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, তাদের প্রতিরোধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এই বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে আমরা আমাদের পরবর্তী করণীয়সমূহের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। সেটি হলো সুস্থ চিন্তার বিস্তার, সুশিক্ষা, মানসগঠন, সচেতনতা সৃষ্টি। এই বিষয়গুলো সমাজের প্রতিটি স্তরে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রযোজ্য।

নারীকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শেখাবার শিক্ষা যেমন এদেশের পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক, তেমনি নিজেকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে জেনে নিজের অধিকার আর মর্যাদার প্রতি সচেতন থেকে সাহসী, শক্তিশালী আর দ্বিধাহীন হবার শিক্ষা প্রয়োজন নারীদের জন্য। এই শিক্ষাই উভয় পক্ষে সচেতনতার প্রসারে ভূমিকা রাখবে। শুধুমাত্র পুরুষকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে নারীর প্রতি সহিংসতা হ্রাসের আশা করা অমূলক, যতক্ষণ পর্যন্ত না নারী অসম সাহসে ঘুরে দাঁড়াবে, পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে রুখে যাবে তার প্রতি ঘটা সব ধরনের অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে।

আমাদের দেশের একটি বিশাল অংশ পুরুষের মনোজগতে নারী একটি সেক্স অবজেক্ট ছাড়া আর কিছু নয়। অধিকাংশ পুরুষই শুধু সুযোগের অভাবে সরাসরি ধর্ষণ করতে পারে না। কিন্তু এই অপারগতা তারা মিটিয়ে নেয় অন্যভাবে। রাস্তাঘাটে নারীর শরীরের প্রতি কুৎসিত নজর হেনে, ভিড়ের অজুহাতে শরীরে হাত দিয়ে, পাশ দিয়ে যাবার সময় নোংরা কথা বলে এরা বিকৃত যৌনানন্দ লাভ করে। এই বিকৃতমনস্ক লোকের সংখ্যা এত বেশি যে আপনি ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবেন। এখন সেক্স পারভার্সন এদেশের পুরুষের ভিতরে এমন মহামারী আকারে ছড়িয়ে গেল কেন, সেটি নিয়ে রীতিমত সামাজিক গবেষণার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলে আমি মনে করি। এটি অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার কিছু তো নেইই, বরং খুবই গুরুত্বের সাথে বিষয়টি চিহ্নিত করা দরকার।

একটি কারণ হতে পারে অবদমন। কিন্তু অবদমনই বা বলি কী করে! বিবাহ হচ্ছে, বাল্য বিবাহও হচ্ছে, উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজে যথেষ্ট মেলামেশার সুযোগ রয়েছে নারী পুরুষে, পুরুষের খেদমতে যৌনপল্লীগুলোকেও বেশ বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এখন তো ইন্টারনেটেও যৌনকর্মীদের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে? তাহলে ধর্ষণ কি আসলে যৌনতা থেকেই আসে? নাকি ধর্ষণ পুরুষের পুরুষত্ব আর নারীর ওপর শক্তি জাহিরের এক মাধ্যম?

নারীকে দখল করতে চাওয়ার মনোবৃত্তি থেকেই ধর্ষণের উৎপত্তি। চাহিবামাত্র নারীটির শরীর কজ্বায় নিতে পারাটাকে পুরুষ তার পৌরুষের বিরাট প্রকাশ বলে মনে করে। কারো কারো ক্ষেত্রে যৌনশক্তির ঘাটতি থাকলেও পেশিশক্তি দিয়ে নারীটিকে ধরাশারী করে তার ভিতরে নিজেকে প্রবেশ করানোকেও কোন কোন পুরুষ নিজের বিশাল বিজয় বলে মনে করে। এ তো পুরুষের মনোজাগতিক সমস্যা!

নিজের স্ত্রী বা প্রেমিকাকে জোর করার মধ্যেও কোন কোন পুরুষ গভীর আনন্দ পায়। একটি নারীকে সে কবুল বা মন্ত্র পড়ে বলে বিয়ে করে এনেছে অথবা প্রেমের সম্পর্ক করেছে, এখন তার ইচ্ছা হওয়ামাত্রই স্ত্রী বা প্রেমিকা বিছানায় নিজেকে মেলে ধরতে বাধ্য বলে মনে করে বহু পুরুষ। এখন স্ত্রী বা প্রেমিকা কেন ‘না’ বলবে, সেই তাদের বোধগম্য হয় না। এখন এই যে তাদের বোধগম্য হয় না, এই আদিম চিন্তা চেতনার উৎপত্তি আসলে কোথায়? এই আদিমতাকে বহন করে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নাইয়ে খাইয়ে তেল চকচকে করে তুলছে এই সমাজ। তাই বৈবাহিক ধর্ষণ এই সমাজে একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা আর এ নিয়ে কথা বললে, পুরুষের চক্ষু কপালে ওঠে। তাহলে কী দাঁড়ালো? ব্যাপারটা তাহলে এই যে ধর্ষণ নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে পুরুষশাসিত এই সমাজে। মানে বিয়ে করলেই আপনি যখন ইচ্ছে স্ত্রীর সাথে যৌনমিলনে যেতে পারবেন। স্ত্রী না বললেও সে ‘না’ না  নয়। আবার আপনি যৌনকর্মী নিয়ে এসেছেন। এখন তাকে আপনি অর্থের বিনিময়ে ভোগ করবেন। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়, আপনি চাইলেই তাকেও ধর্ষণ করতে পারেন। সে আপনাকে সার্ভিস দিতে এসেছে, কিন্তু যেকোন মুহূর্তে, যেকোন কারণে সে আপনাকে না বলতে পারে, এবং সেই না এর পরও যদি আপনি তাকে জোর করে যৌনমিলন করেন, তবে অবশ্যই অবশ্যই সেটি ধর্ষণ।

যৌনকর্মীকে ধর্ষণ হালাল নয়, আপনি চাইলেই তার সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন না। কিন্তু এই দেশে কোনদিন কোন যৌনকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ করতে দেখেছেন থানায় গিয়ে? কেন দেখেননি? কারণ এই পুরুষের সমাজে, পুরুষের রাষ্ট্রে, পুরুষের থানাওয়ালা, আইনওয়ালাও মনে করে, যৌনকর্মীকে চাইলেই ধর্ষণ করা যায়। তাই যৌনকর্মী ধর্ষণের অভিযোগ আনলে তাকে অশ্রাব্য গালি দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হবে, এটাই এদেশের নিয়ম।

পরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে গেল বলে ধর্ষণ নিয়ে লিখতে আবার কলম ধরতে হল। এই নিয়ে ধর্ষণ বিষয়ে কততম লেখা লিখছি, মনে করতে পারি না। এত কথা, এত প্রতিবাদের পরও এই দেশে ধর্ষণ থামে না। তার চেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপারটি হল, বহু বহু ধর্ষণের ঘটনার কোন ধরনের বিচার হয় পাওয়া যায়নি। তনু ধর্ষণের মত ব্যাপক আলোচিত ঘটনাটি কোন অন্ধকারের অতলে হারিয়ে গেল!

একটি রাষ্ট্র কতখানি জবাবদিহীহীন আর আইনের শাসনহীন হলে এরকম ঘটতে পারে! ধর্ষণের মামলা করতে না পেরে হযরত আলী আর আট বছরের কন্যা আয়েশার আত্মাহুতির পর এই দেশে সরকারের নির্বিকার মুখ আমরা দেখি। কোন সভ্য দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এমপি’র লজ্জায় ঘৃণায় পদত্যাগ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা উন্নয়নের নামে পদ জাকিয়ে বসে থাকি আর আর নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি। তাই পূজা ধর্ষণের মামলাটি আসলে কী অবস্থায় আছে, জানি না। পূজা, মনে আছে আপনাদের?

ওই যে সাত বছরের বাচ্চাটির যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করল প্রতিবেশি পঞ্চাশ বছরের পুরুষটি! প্রায় সাত আটমাস পেরিয়ে গেছে। দ্রুততম সময়ে শিশু ধর্ষণের শাস্তি দেবার জন্য কি পূজার ঘটনাটি কি যথেষ্ট চাঞ্চল্যকর, ভয়ানক আর বীভৎস নয়? ঠিক আর কতটা বীভৎসতা নিয়ে হাজির হলে আপনারা ধর্ষণের শাস্তি আরো কঠোর করবেন? ধর্ষণকে কখন আপনাদের সেই রকম বড় অপরাধ মনে হবে, যখন আপনারা ধর্ষণ মামলার রায় দ্রুত দেবার ব্যবস্থা করবেন? কবে থেকে এই দেশে ধর্ষণ মামলা জামিন অযোগ্য হবে? কবে? এর জন্য কতবার আত্মাহুতি দিতে হবে হযরত আলী আর আয়েশাদের?

ধর্ষণের মামলা করা, ডাক্তারি পরীক্ষা, আদালতে জেরার মুখোমুখি হওয়া- এইসব ধর্ষিতাদের জন্য কঠিন কষ্টের ব্যাপার। আমরা জানি। এক্ষেত্রে নিজেকে কঠিন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দৃঢ় তেজি আর স্পষ্টভাষী করে তোলা ছাড়া এই কষ্ট থেকে রক্ষা পাবার আর কোন উপায় আছে বলে আমার জানা নাই। আপনার ওপর অন্যায় হয়েছে, আপনি কোন অন্যায় করেন নাই- এই বিষয়টা মাথায় রাখতেই হবে। ধর্ষণ মানে আপনার ইজ্জত চলে গেছে, আপনাকে ওড়নায় মুখ ঢেকে থানায় আর আদালতে যেতে হবে- এই চিন্তা ভাবনার জায়গাটি পরিবর্তন করা খুব জরুরি।

আমি চাই ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মাথা উঁচু করে থানায় আদালতে যাক, স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে আসুক তার ওপর করা অবিচারের কথা। আপনাকে নানাভাবে হেনস্থার চেষ্টা করবে এই পুরুষের সমাজের আইজীবী, পুলিশ। যদি ঘাবড়ে যান, তবেই পরাজয়। লড়াই তো কেবল শুরু। দৃঢ়চেতা, সাহসী থাকাই আপনার মূল অস্ত্র। সাংবাদিকের ভয়ে কেন আপনি লুকিয়ে থাকেন? কথা বলুন। নিজেকে প্রকাশ করুন। মনে রাখবেন, এই সমাজ শুধু কোনঠাসাই করে চলেছে আমাদের, প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে। তাই এ সমাজে আমাদের ওপরে অবিচার হলেও অপরাধী আমরাই। এই যখন এই সমাজের মনস্তত্ত্ব, সেই সমাজের মুখে একদলা থুতু ছুঁড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই হোক আমাদের লক্ষ্য। না, মুখ ঢেকে রাখবেন না, লুকিয়ে থাকবেন না, চুপ করে থাকবেন না, লজ্জা পাবেন না। শুধু ভালোবাসবেন নিজেকে। আর তুমুল সাহসে সব ঝোপঝাড় কেটে সামনে এগোবেন। দিন আসবেই।

যে রাষ্ট্র আজ ধর্ষককে পাহারা দিয়ে দুধকলা খাইয়ে যত্নে পেলে পুষে রাখে, সেই রাষ্ট্রকে নতজানু করতে, ধর্ষকের কঠিন আর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে আপনার আমার লড়াই জারি থাকুক। এ সমাজে বিত্তবান পরিবারের পুরুষেরা আজ অর্থ বিত্তের দাপটে ধর্ষণের উৎসব করার সাহস পায়, রাষ্ট্র তাদের দেখেও দেখে না। দিনের পর দিন পার হয়, অপরাধী গ্রেফতার হয় না। এরকম অভাবনীয় একটি রাষ্ট্র আমাদের! এই অবসরে ধর্ষণের শিকার মেয়েদের চরিত্র বিশ্লেষণে নেমে পড়ে সুধী সমাজ। হায়রে।

মেয়ে, এই চরিত্র শব্দটিকে আপনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন যেইদিন, মুক্তি ঘটবে সেইদিন। ধর্ষণ একটি অপরাধ। একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কোন অবস্থাতেই কোন কারণেই ধর্ষণের কোন ক্ষমা নেই, ধর্ষণের পক্ষে কোনদিন কোন যুক্তি থাকতে পারে না। আজ যাদের ভয়ে, যে সমাজের চোখে কলঙ্কিনি হবার লজ্জায় আপনি আতঙ্কে বেদনায় অস্থির, মনে রাখবেন, আপনার কলঙ্ক বলে কিছু নেই। আপনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বিচার চেয়েছেন। আপনি সাহসী। আপনাকে স্যালুট। কিন্তু যেতে হবে আরো অনেকটা পথ। অনেক কিছু আদায় করে নেবার আছে আমাদের- এই ধর্ষকামী সমাজ আর রাষ্ট্রের কাছ থেকে। তার আগে চুপ করে বসে থাকবার কোন সুযোগ আর নেই।

লেখক : লেখক : প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন