বিনা নোটিশে কর্মী ছাঁটাই কতটা মানবিক?
সম্প্রতি বিনা নোটিশে সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রায় ৬০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেছে দৈনিক ইনকিলাব। এছাড়া পত্রিকাটিতে যারা কর্মরত আছেন তাদের ওয়েজবোর্ডের পরিবর্তে নির্ধারিত বেতনে চাকরিতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের বহু কর্মী দুই বছরের বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না। কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, ওয়েজবোর্ডের পরিবর্তে নির্ধারিত বেতনে চাকরি করলেই তাদের রাখা হবে।
দেশের ঐতিহ্যবাহী ও শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের এমন কর্মকাণ্ড মোটেও প্রত্যাশিত নয়। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে পত্রিকাটি গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মেহনতি মানুষের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হয়েছে। অথচ আজ প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মীদেরকেই চরম হতাশা আর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেদিন ইনকিলাবের এই খবর চোখে পড়ল, হঠাৎ করেই বছর তিনেক আগের স্মৃতিগুলো একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠল।
২০১৪ সালে আমার বাবার সঙ্গেও এমন ঘটনাই ঘটেছিল। ২০১০এর দিকে একটি ইংরেজি দৈনিকে যোগ দেন তিনি। আকর্ষণীয় বেতন আর সুযোগ-সুবিধায় বেশ ভালো চলছিল আমাদের। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানটি এক যোগে বহু লোককে বিনা নোটিশে ছাঁটাই করে। বিশেষ করে যারা ওয়েজবোর্ডের অধীনে বেশি বেতন পাচ্ছিলেন তাদেরকেই ছাঁটাই করা হলো। প্রতিদিনই কারো না কারো চাকরি চলে যাচ্ছে। সব কিছু দেখে আমার বাবা খুব চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে আমাদের কাউকে কিছু বুঝতে দেননি। কখনো নিজের দুশ্চিন্তার কথাও আমাদের বলেননি। কিন্তু যেদিন অফিস থেকে আমার বাবাকেও জানানো হলো যে তাকে আর এই প্রতিষ্ঠানে রাখা হচ্ছে না তখন তার ওপর দিয়ে কি গেছে, তিনি যে সুস্থ অবস্থায় বাসায় ফিরেছেন এটা আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল বলতে হবে। কারণ আমার বাবা একটু নরম স্বভাবের মানুষ। এত বড় একটা দুসংবাদ তাকে খুব আঘাত করেছে। অফিস থেকে সুস্থভাবে তিনি বাসায় ফিরতে পেরেছেন বলে আমাদের পরিবারটা আজ টিকে আছে।
বাবা প্রতিদিনের মতই রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। আমরা ভাই-বোনেরা বসে বসে গল্প করছিলাম, টিভি দেখছিলাম। আম্মু একটু অসুস্থ বলে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম বাবা এলে একসঙ্গে খেতে বসব। আব্বু ঘরে ঢুকলেন। পানি খেয়ে কাপড় বদলালেন। আমাদের কিছু বললেন না শুধু আমার ছোট ভাইকে আলাদা করে ডাকলেন। ওকে কাছে ডেকে বললেন, বাবা আমার চাকরিটা নেই। আজ অফিস থেকে লেটার দিয়েছে কাল থেকে আর যেতে হবে না। আমার ভাই তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বলতে গেলে এসব বোঝার মত বা পরিবারের হাল ধরার মত ততটা বড় সে না। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার এই ছোট্ট ভাই সেসময় অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল। আব্বুকে সে সান্ত্বনা দিল, তুমি চিন্তা করো না আমরা তো আছি। কিন্তু বাস্তবে আমরা যে কয়টা মানুষ ছিলাম তারা কেউই তখন ততটা উপযুক্ত না। বিশেষ করে আমাদের পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আর আমরা বোনেরা কয়েকটা টিউশনি করতাম। তাতে যা পেতাম তা দিয়ে অন্তত এত বড় পরিবারটা চালানো মোটেও সম্ভব ছিল না।
বাবা যে বেতন পেত তা দিয়ে আমাদের দিব্যি ভালোভাবে কেটে যেত। হঠাৎ করেই তার চাকরিটা চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছিল আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম, পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছিল। কাল থেকে আমাদের কিভাবে চলবে সেটাও ভাবতে পারছিলাম না। এতটা অসহায় আর কখনো লাগেনি। আমরা ভাই-বোনেরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছামত কাঁদলাম। মনে হলো সব কিছু এখানেই শেষ। জোরে শব্দ করে কাঁদতেও পারছিলাম না। কারণ মায়ের শরীরটা ভালো না। তাকে কিছু জানানো যাবে না। আব্বুর চাকরি নেই এটা সে সহ্য করতে পারবে না। এটা জানলে তার শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে।
সবাই মিলে ঠিক করলাম আম্মুকে এখন কিছুই জানাবো না। আম্মুকে বলব আব্বু অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে। আমার বাবার কোনো সঞ্চয় ছিল না। থাকবেই বা কিভাবে? প্রতি মাসে যা আয় করেছেন তা আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পড়াশুনার পেছনেই ব্যয় করেছেন। তিনি সব সময় একটা কথাই বলেন, তার ছেলে-মেয়েরাই তার সম্পদ। তাদেরকে সঠিক ভাবে মানুষ করতে পারলেই তার আর কিছু চাওয়ার নেই। বাবা-মাকে কখনো নিজেদের জন্য কিছু করতে দেখিনি। আমার মা বছরে দুইটার বেশি শাড়ি কখনো কেনেননি। বাবাও কোনো বাজে খরচ করেননি। যে রাস্তায় রিক্সা দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয় সেখানে তিনি হেঁটেই যাওয়া-আসা করেন। বলেন হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। আসলে আমরা জানি এটা শরীর ভালোর জন্য না। তিনি ভাবেন বাজে খরচ করে লাভ কি? এইটুকু রাস্তাতো হেঁটেই যাওয়া যায়।
ইনকিলাবের যে লোকগুলো চাকরি হারিয়েছেন তাদের পরিবারগুলো এখন কোথায় যাবে? কি করবে? তাদেরও নিশ্চয় আমাদের মতই অবস্থা হয়েছে? ওই সময়গুলোতে কতটা কষ্ট করেছি আমরা। বেশিরভাগ দিনই আলু ভর্তা, ডাল, ডিম ভাজি আর ভাত। এই ছিল খাবারের মেন্যু। তার ওপর বাড়ি ভাড়ার চাপ। আরো কত কিছু। তবে এ নিয়ে আমাদের কারোরই কষ্ট ছিল না। আমরা তো জানতামই আব্বুর চাকরিটা নেই। চাকরি যাওয়ার পর আব্বু একটা চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করলেন। এর আগে প্রায় বিশ বছর প্রথম সারির একটি ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করেছেন। সেই সুবাদে বহু মানুষের সঙ্গে চেনা জানা ছিল। সব জায়গাতেই খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না। আমরা বোনেরা টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছিলাম। এক একটা দিন যেন এক একটা বছর মনে হচ্ছিল।
কয়েক মাস যাওয়ার পর আব্বু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নামমাত্র বেতনে ঢুকলেন। কিন্তু আমাদের বুঝি কপালই খারাপ। দিনরাত বাবাকে গাধার মত খাটতে হতো। অথচ মাস শেষে বেতন দিচ্ছিল না। দুই তিন মাস পরে এক মাসের বেতন দিচ্ছিল। এমনিতেই সেখানে বেতন কম তার ওপর আমাদের পরিবারও বড়। দুই তিন মাস পরে এক মাসের বেতন পেলে তা দিয়ে কোনোভাবেই চলতে পারছিলাম না। এখানে সেখানে ঋণও করতে হচ্ছিল। কিন্তু কয়দিন ঋণ করে চলা যায়? আবার বেকার হয়ে বসে থাকাটা আব্বু মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই এই চাকরিটা ছাড়লেন না। প্রায় দু’বছর এমন টানাপড়েনের পর বাবা ভালো একটা ইংরেজি দৈনিকে যোগ দেন। এই টানা দুই বছর আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে যে কি ঝড় বয়ে গেছে তা শুধু আমরাই জানি।
এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ। একজন মানুষ একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ যখন কাজ করেন তার অনেক স্বপ্ন থাকে। পরিবার পরিজনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। হুট করেই চাকরি চলে গেলে মানুষগুলোর পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। একটা মানুষ যতই যোগ্য হোক না কেন চাইলেই রাতারাতি একটা চাকরি পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। বিশেষ করে পত্রিকার মালিকরা হঠাৎ করেই বিনা নোটিশে বয়স্ক সাংবাদিক বা তাদের কর্মীদের চাকরিচ্যুত করে, যা খুবই অমানবিক। বয়স্কদদের বেতন বেশি দিতে হয় বলেই হয়তো এমনটা করা হয়। কিন্তু তাদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই। সাংবাদিকদের জন্য পেনশন সুবিধাও নেই। যেসব সাংবাদিকরা তরুণ বয়সে পত্রিকার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন তারা প্রবীণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিচ্যুত করা হয়। সাংবাদিকরা তাদের লেখনী দিয়ে সমাজ থেকে অন্যায়, অপরাধ দূর করতে আপ্রাণ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দেশ-বিদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খবরগুলো তারা মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু তারাই যদি এভাবে অবহেলিত হন তাহলে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন কিভাবে আর কিভাবেই বা তারা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবেন?
বিচারহীনতা থেকে বের হতে না পারলে, জবাবদিহিতা না থাকলে দেশে গণমাধ্যমের কোনো উন্নয়ন হবে না, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও রক্ষা করা সম্ভব হবে না। শুধু পত্রিকা নয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই এই মানবিক বিষয়গুলো চিন্তা করা উচিত। প্রতিষ্ঠানগুলোর শুধু নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করলে হবে না। তাদের কর্মীদের সঙ্গে পরিবারের মানুষগুলো জড়িয়ে আছে। কোনো কর্মী হয়তো চাকরি করে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখছেন, কেউ সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কষ্ট করছেন, আবার কেউ হয়তো ভাই-বোনের সমস্ত দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরি চলে গেলে এই অসহায় মানুষগুলোর কী হবে সেটাও প্রতিষ্ঠানের ভাবা উচিত। প্রতিষ্ঠান তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন কর্মীকে ছাঁটাই করার আগে তাকে অন্তত কয়েক মাস সময় দেওয়া উচিত যেন তারা নতুন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। আর তারা প্রতিষ্ঠানের কাছে যে টাকা পাবেন সেটাও ছাঁটাই করার পর তাদের পরিশোধ করে দেওয়া উচিত যেন নতুন করে কোথায় চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তারা পরিবার নিয়ে চলতে পারেন।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস