বাবা-মেয়ের আত্মহত্যা : আমরা কোথায় আছি?
কন্যাকে রক্ষা করতে না পেরে এক অসহায় পিতার যন্ত্রণা। শেষ পর্যন্ত কন্যাকে নিয়ে একসঙ্গে ট্রেনের চাকায় প্রাণ বিসর্জন। গাজীপুরের শ্রীপুরে সম্প্রতি সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনাটির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। মাত্র আট বছরের মেয়ে আয়শা। জন্মের পর থেকেই মেয়েটিকে পরম যত্নে, স্নেহে পালন করেন তার পালক পিতা হযরত আলী। কিন্তু স্নেহ-মমতা থাকলেও ছিল না অর্থ সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি। প্রতিবেশি দুর্বৃত্ত বখাটে ফারুকের নির্যাতন থেকে তাই মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারেননি পিতা। বারে বারে নালিশ জানানোর পরও সমাজের প্রভাবশালীরা এই নির্যাতনের কোন বিচার করেনি। অসহায় পিতা ক্ষোভে, দুঃখে কন্যাকে সঙ্গে নিয়েই আত্মহত্যা করলেন। কী মর্মান্তিক। এবং কী লজ্জাজনক যে এমন একটি সমাজে আমরা বাস করি। জীবন দিয়ে দরিদ্র হযরত আলী দেখিয়ে গেলেন আমাদের বাস্তব অবস্থা কি ভয়াবহ।
এতবার লেখা হচ্ছে, এত খবর প্রকাশ হচ্ছে, কত মেয়ে আত্মহত্যা করছে, কত মেয়ে ধর্ষণ, অপহরণ ও খুনের শিকার হচ্ছে তবু কিছুতেই সমাজ থেকে বখাটেদের উৎপাতকে রোধ করা যাচ্ছে না। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন, কেন রোধ করা যাচ্ছে না? যখন কোন মেয়ের অভিভাবক বিষয়টি নিয়ে থানায় বা গ্রামের মাতবরদের কাছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে বা ইউএনওর কাছে অভিযোগ করেন তখন কেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না?
বখাটের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তার অভিভাবকসহ থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বখাটেদের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে যখন তার বাবা-মায়ের কাছে কেউ যায় তখন বাবা মা সেটিতে কোন গুরুত্ব আরোপ তো করে না, উল্টো নালিশকারীকেই অপমান করে। ছেলেকে শাসন করে না এবং প্রশ্রয় দেয়। বখাটেরা অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়ও থাকে।
এর আগে রিশা, নিতু মণ্ডলসহ বেশ কয়েকজন মেয়েকে বখাটেরা হত্যা করেছে। খাদিজাকে কুপিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ইয়াসমিন নামের আরেকটি মেয়েকে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করতো। ইয়াসমিনের দিন মজুর বাবা তাদের বাধা দেওয়ায় তাকে কুপিয়ে দুই পা কেটে ফেলে বখাটেরা। বর্ষবরণ উৎসবে হাজারো মানুষের চোখের সামনে অসংখ্য নারীকে নির্যাতন করে পালিয়ে গেল বখাটেরা। এখন পর্যন্ত সেই ঘটনায় মাত্র একজনকে ছাড়া আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হযরত আলী ও তার মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনাতেও পুলিশ মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে বলা হয় ভুল লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে অসংখ্য কিশোরী, তরুণীর শিক্ষাজীবন মাঝপথে থেমে যাচ্ছে শুধুমাত্র বখাটেদের নির্যাতনে। স্কুলে কলেজে যাতায়াতের পথে ওত পেতে থাকছে বখাটেরা। তারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছে, শারীরিক মানসিক নির্যাতন করছে। কিছুদিন আগে ঢাকার মিরপুরে দুই যমজবোনকে শত লোকের চোখের সামনে পিটিয়ে আহত করেছে বখাটেরা।
এইভাবে দিনের পর দিন চলছে। কোন প্রতিকার নেই। আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসন ও সমাজপতিরা একটু তৎপর হলেই কিন্তু বখাটের উৎপাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে পারে। বখাটেরা তো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা প্রাণী নয়। তারা এই সমাজেরই কোন না কোন পরিবার থেকে আসে। পরিবারের সদস্যরা যখন দেখে তাদের বাড়ির সন্তান বখাটেগিরি করছে, নারীদের উত্ত্যক্ত করছে তখন তারা কেন শাসন করে না। তারা যদি পরিবার থেকে এদের নিয়ন্ত্রণ করতো তাহলে তো কিছুরই দরকার হতো না। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে বখাটের পরিবার ভিকটিমের পরিবারের উপর উল্টো চড়াও হয়েছে। হযরত আলির ঘটনাতেও দেখা গেছে অভিযুক্ত ফারুক নালিশ করায় ক্ষেপে গিয়ে আয়শাদের গরু ধরে নিয়ে যায়। এরও কোন বিচার হয় না।
সমাজের প্রধান যারা তারও ভিকটিমকেই দোষী সাব্যস্ত করে। কারণ প্রভাবশালী বখাটেদের তারা সমর্থন যোগায়। যেহেতু ভোটের সময় এইসব বখাটেই তার কাজে আসবে, হযরত আলীর মতো নিরীহ লোকরা নয়। বখাটেদের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সেই সঙ্গে আইনের শক্ত শাসন। চীনদেশে থাকার সময় দেখেছি সেখানে ইভটিজিং এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইন এবং তার প্রয়োগ খুবই কঠোর। ফলে সেখানে পথে ঘাটে বাসে সাবওয়েতে কাউকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় না। সেখানে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বছরের পর বছর বিচার ঝুলেও থাকে না। দ্রুত বিচার, দ্রুত শাস্তি। ফলে মেয়েরা নিরাপদে চলতে পারে।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এমনি কঠোর আইন ও প্রয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হলো, সর্ষের মধ্যেই তো ভূত। কিছুদিন আগেই তো এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তারই এক সহকর্মী নারী কনস্টেবলকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের সদস্যদের বিরুদ্ধেই যদি নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তাহলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদবে।
এই প্রতিকারহীন সমাজে বাবা মেয়েকে আত্মহত্যাই করতে হবে।সুশীল সমাজ কয়েকদিন বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে তারপর আবার অন্য ইস্যুতে ব্যস্ত হবে। আজও পর্যন্ত তনু, মিতুর খুনিদের সনাক্ত করা যায়নি। শাস্তি তো দূরের কথা। অসহায় হযরত আলি আর অয়েশার মৃত্যু আমরা ভুলতে চাই প্রাণপণে। তবু ঘুমের ভিতরও মনে হয় ট্রেনের চাকায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে আয়শা বলছে, ‘বাজান, আমরা কি মইরা যামু?’ বাবা উত্তর দিচ্ছে, ‘অহনই বা কি বাঁইচা আছি মা?’
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস