ক্ষমতার জানালায় বসে তারা মানুষ দেখে না
সামাজিক অসাম্য যাদের পায়ের তলায় চেপে রাখে, তাদের জন্য পথ দুটি– হয় মরো, নয়তো মারো। শ্রীপুরের হযরত আলী প্রথমটিই বেছে নিয়েছিলেন। অসহায় মানুষটি তার দশ বছরের মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের গায়ে থুতু ছিটিয়ে। স্থানীয় পুলিশের দু’একজন হযরত আলীকে পাগল বলার চেষ্টাও করছেন। এমন অন্যায়, অন্যায়ের প্রতি এমন সমর্থন, তবুও এদেশের মানুষ বিক্ষোভ ফেটে পড়েনি, হাতে উঠে আসেনি লাঠিসোঁটা। আমাদের এখনকার সমাজ কেবলই অন্যায় সইতে ব্যস্ত।
ষাটের দশকে মাও সেতুং-এর শ্লোগান ছিল বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। বামদের প্রিয় এই শ্লোগান দেখা যেতো শহরে, বন্দরে, গ্রামের পথে ঘাটে। এখন এই শ্লোগান সামন্তবাদি যেসব দল ক্ষমতায় আসে তাদের আদর্শ। যাদের কাছে বন্দুক আছে, ক্ষমতার জোর আছে, তাদের পক্ষেই প্রশাসন কথা বলে। তাই অন্যায়ের বিচার না চেয়ে হযরত আলীদের মরে যেতে হয়।
আসলে আমাদের শাসন ব্যবস্থার চরিত্রই এমন যে শাসক গোষ্ঠী ক্রমশ ক্ষমতায় বসার পর থেকেই অধিকাংশ জনগণের মঙ্গল সম্পর্কে উদাসীন হতে শুরু করে। ক্ষমতা মুষ্টিমেয়র হাতে সংহত হয় এবং রাষ্ট্র ক্রমাগত সেই ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এক যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণের ইচ্ছা এবং স্বপ্নের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবধান প্রান্তর প্রান্তর হয়। আর এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হযরত আলীতে পরিণত হয়। নির্বাচন আমরা করি বটে, জনগণ ভোটও দেয়, কিন্তু রাষ্ট্র সামাজিক সম্মতিতে তৈরি এক সংগঠন না থেকে হয়ে উঠে এক নিপীড়ক যন্ত্র।
জনগণের সম্মতি নেয়ার একমাত্র সূচক সাধারণ নির্বাচন। মানুষ ভোট দেয় কত প্রত্যাশা করে। কিন্তু কোন দল জয়ী হয়েই মানুষের সেই সম্মতিক স্বেচ্ছাচারিতার সনদ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। আমাদের গণতন্ত্রের কাঠামোর ভেতরের দুর্বলতা এটি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভাবতে শুরু করেন ভোট শেষ, এখন একমাত্র কাজ জনগণ আর জনমতকে উপেক্ষা করে নিজস্ব পছন্দ অনুসারে কাজকর্ম করেন। হয়রত আলীর মেয়েকে যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের যারা মৃত্যু পথে পাঠিয়েছে, তারা এই কাঠামোর সুবিধাভোগী।
গণতন্ত্র ব্যবস্থার এই সব দুর্বলতায় বীতশ্রদ্ধ হতে পারে মানুষ, কিন্তু কিছু করার আর থাকে না। মানুষ শুধু অপেক্ষায় থাকে, আবার ভোট এলে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু আবার যারা আসে, তারা আরো ততোধিক বেগে অন্যায়ের পথে হাঁটতে থাকে। ইতিহাসে দেখা গেছে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন সমূহ কখনো কখনো সশস্ত্র সংগামে পরিণত হয়েছিল, যেমনটা আমরা করেছিলাম ১৯৭১-এ। এবং এসব ক্ষেত্রে বামদের ভূমিকাই থাকে বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সেরকম বাম নেই, নির্যাতিত মানুষের পক্ষাবলম্বনকারী সামাজিক ন্যায়ের কোন যোদ্ধাও নেই।
ক্ষমতায় থাকা বা তাদের নেতৃত্ব কিছু কিছু জনকল্যাণধর্মী কাজ করে ঠিকই। কিন্তু সামাজিক অসাম্য যদি ব্যাপক মানুষকে পায়ের তলায় চেপে রাখে, তখন সামাজিক সংস্কারের জন্য অপেক্ষা করা কঠিন। স্বচ্ছ প্রশাসন এবং নিম্নতম স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রসারের সুযোগ আসলে দেশে আর নেই। রাজনীতি মাত্রই পেশি শক্তির প্রদর্শনী। কোনটি অর্থের, কোনটি বন্দুকের, কোনটি আবার ধর্মের নামে চাপাতির। প্রান্তিক পর্যায়ে যারা কেন্দ্রের হয়ে রাজনীতি করে বা প্রশাসন চালায়, তাদের একমাত্র কাজ হুকুমত বজায় রাখা। কোন কাজ বা প্রকল্প জনমত দ্বারা সমর্থিত কিনা কে তার খোঁজ রাখে?
হযরত আলীদের যারা মারে তারাই হাওরের মানুষকে কষ্টে ভাসায়। তাদের প্রকল্পের টাকা মেরে দেয়। রাজনীতি আর প্রশাসন এক হয়ে এখন শোষণের জাল বিস্তার করেছে। আরেকটি স্বচ্ছ ভোটে যে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে, সে আশা করে লাভ নেই। যারা অপেক্ষায় আছে আসবে বলে, তারা এসে আরো বেশি বুভুক্ষের মতো আচরণ করবে, আরো বেশি সংহারে ব্যস্ত থাকবে।
সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা চাই, এর কোন বিকল্প নেই। শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রতিটি সমাজ-সংগঠনের কাছ থেকে এই স্বচ্ছতা দাবি করা প্রয়োজন। দাবি করা প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের, যাতে দ্রুত এবং স্বল্পতর খরচে ন্যায় বিচার পাওয়া যেতে পারে। বিচার পাবেনা জেনেই হয়রত আলী আদরের কন্যাকে নিয়ে ট্রেনের তলে ঝাঁপ দেয়, প্রকাশক দীপনের বাবা বলেন, বিচারের পাবেন না, তাই পুত্র হত্যার বিচার তিনি চান না। আমাদের পুলিশি ব্যবস্থাকে মানবিক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ করে তোলা যায়নি আজও। জনতার রাজপথ ধরে একের পর এক সরকার আসে, যায়। তারা ক্ষমতার অলিন্দে বসে কেবলই নিজেদের সুবিধার পথ দেখে, মানুষ দেখেনা। মানুষের কথা মনে রাখলে কি আর অন্ধকারের শক্তির সাথে সখ্য করে?
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস