জঙ্গি অর্থায়ন
এ লেখা যখন লিখছি তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে পুলিশের বিশেষায়িত দল সোয়াট। এবং এ লেখা যখন প্রকাশ হবে, ততক্ষণে হয়তো পুলিশের আরো একটি সফল অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে। হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গি খতমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক সাফল্য আমরা দেখছি। জনসমর্থন না থাকলেও এদেশে জঙ্গিদের এই বাড়-বাড়ন্তের প্রধান কারণ এদের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন এবং অর্থায়ন।
জঙ্গি অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা। দেশে দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মভিত্তিক যেসব দল রাজনীতি করছে এবং অন্য সাধারণ যেসব দল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছে, তারা সবাই এদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। তবে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী সাধারণ দলগুলোর মতো রাজনীতি করেনি। তারা দলের পক্ষ থেকে গড়ে তুলেছে এক মহা আর্থিক জগৎ। আরব অঞ্চল থেকে পেট্রোডলারও ভূমিকা রেখেছে এই অর্থায়ন প্রক্রিয়ায়।
দেশে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর নামে নানারকম তৎপরতা চালানো হলেও এর হোতারা অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। পুলিশী অভিযানে খতম করার পাশাপাশি কারা কোথা থেকে কীভাবে জঙ্গিদের অর্থ জোগাচ্ছে তা উদঘাটন করা বড় কাজ। গত বছর সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন নাগরিকের বিরুদ্ধে দেশে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। জঙ্গি অর্থায়নের একটি উৎস এটি বলা যায়। দেশের বাইরে, বিশেষ করে মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ, লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের একটি বড় ধর্মভিত্তিক দলের মসজিদ ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিভিন্ন দেশে গোপন অর্থ সংগ্রহের কার্যক্রমে অনেক বাংলাদেশি জড়িত রয়েছে এবং তারা দেশে জঙ্গি তৎপরতায় সহায়তা করে আসছে।
দেশে জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে এদের চিহ্নিত করা জরুরি। জঙ্গি তৎপরতা বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখছে এর পেছনে অর্থায়ন। সঙ্গত কারণেই বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা কর্তব্য। বছর দুয়েক আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)এক প্রতিবেদনে ঢাকা ও সিলেটে ব্লগার হত্যার সঙ্গে জড়িত এক মাদ্রাসাশিক্ষক ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের চ্যানেল ব্যবহার করে জঙ্গিদের প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা দিয়েছিল বলে উঠে এসেছিল। অন্যদিকে জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডকে অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মহিলা এক ব্যারিস্টারসহ তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যারব। এগুলো সবই জঙ্গি অর্থায়নের ভয়াবহতাকে নির্দশে করে। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে জঙ্গি অর্থায়ন হয়তো আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি অর্থায়ন যারা করছে সেসব প্রতিষ্ঠান তেমনভাবে চিহ্নিত হচ্ছে না।
এ পর্যন্ত যারা জঙ্গি অর্থায়নে যুক্ত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। ব্যাংক হিসাব খোলা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপারেশনের ওপর কার্যকর মনিটরিং থাকলে জঙ্গি অর্থায়নের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা যেমন সম্ভব, তেমন সম্ভব অর্থের জোগানদারদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনা।
সম্প্রতি আমরা দেখছি, জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দারাও সতর্ক আছে। তবে একথাও নিশ্চয় সত্য যে, জঙ্গিরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী, আগের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তারা। আর এসব কিছুর কারণ তাদের অর্থের জোর। প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে গেলে শক্তিশালি অর্থের সরবরাহ থাকা লাগে।
দেশে জঙ্গি তৎপরতা ও কার্যক্রম ভয়াবহ রকম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার জেএমবি, হুজিসহ চারটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিষিদ্ধ করায় সরাসরি অর্থ সংগ্রহ ও পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে যেসব দল ও গোষ্ঠি এখনো নিষিদ্ধ হয়নি, তারা এখানে কোন ভূমিকা রাখছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
কিছুদিন আগে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলে জঙ্গি অর্থায়নসহ মানি লন্ডারিং অবশ্যই হ্রাস পাবে। তার একথা গুরুত্বসহ ভাবতে হবে। তবে এমন অভিযোগও আছে যে, বাংলাদেশের জঙ্গিরা সহজেই পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে। ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দুইজন কর্মকর্তা বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতায় ধরা পড়ে পাকিস্তানে ফেরত যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, সরাসরি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করছে, তাই এখানে কর্মরত পাকিস্তানি নাগরিকদের মাধ্যমে জঙ্গিদের কাছে অর্থ যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
পাকিস্তানের কয়েক হাজার নাগরিক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। এর বাইরে আরো একটি বড় উৎস হতে পারে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু অংশে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা শরণার্থী। রোহিঙ্গা বসতি এলাকাকে কেন্দ্র করে অনেক মাদ্রাসা গড়ে ওঠেছে, যেখানে বিভিন্ন ছদ্মবেশে জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট ও প্রশিক্ষণের কাজ চলছে বলে খবর আসছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলো ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা নিবিড় সংযোগ ও সম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গা জঙ্গিদের প্রাপ্ত অর্থের বড় একটা অংশ চলে আসে বাংলাদেশি জঙ্গিদের হাতে।
তবে বাংলাদেশে জঙ্গিদের অর্থের প্রধান উৎস বাংলাদেশের ভেতরেই। এবং সেখানে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির বড় ভূমিকা আছে। জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পুলিশি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি অর্থের উৎস বন্ধ করতেই হবে। অর্থের সরবরাহ যতদিন অব্যাহত থাকবে জঙ্গি তৎপরতাও থাকবে ততদিন।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস