প্রয়োজন সাংস্কৃতিক মুক্তিযুদ্ধ
অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের চেতনা থেকেই এদেশের সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সম্পূর্ণভাবে একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর যে সংবিধান রচনা করা হয় সেটিও ছিল অসাম্প্রদায়িক। সংবিধানের চারটি মূলনীতিও অসাম্প্রদায়িকই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর ধীরে ধীরে এদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি আবার থাবা বিস্তার করতে থাকে।
গ্রামেগঞ্জে, শহরে, বস্তিতে, তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্মেলনের আড়ালে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হতে থাকে। এদেশে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রচার হতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রচুর নাগরিক আছেন। তারা প্রচণ্ড শ্রম দিচ্ছেন সেখানে এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন দেশে। তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তারা কিন্তু অবচেতনভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হচ্ছেন। সেই প্রভাব তারা নিয়ে আসছেন এদেশেও। তারা অবশ্য ভাবছেন এটাই প্রকৃত ইসলাম ধর্ম। কিন্তু সংস্কৃতি ও ধর্ম এক নয়। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। কিন্তু একটি কথা ভুললে চলবে না যে, আমরা কিন্তু বাঙালিও। আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, রয়েছে লোকাচার। যেগুলোর সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে লোকজ শিকড়ের। কিন্তু আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেশ অনেক বছর ধরেই ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র ধর্মীয় আচরণ এবং মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ। এগুলো রুখতে হলে কাজ করতে হবে তৃণমূল পর্যায় থেকেই।
আমাদের এখন দরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায় মহল্লায় দরকার সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাজ করা। একসময় উদীচীর কর্মীরা এভাবে কাজ করেছেন। ভারতে গণনাট্যসংস্থা বা আইপিটিএ একসময় সাংস্কৃতিক জাগরণের কাজ করেছেন। যেকোন দেশের গণমানস গঠনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সংস্কৃতিকর্মীদের কাজ শুরু করতে হবে তৃণমূল পর্যায় থেকেই। সারা বছর ধরে যদি বাঙালি সংস্কৃতির চেতনাবাহী ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতে থাকে, হতে থাকে প্রতিযোগিতা তাহলে গণমানসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি যে কাজগুলো করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। দরকার আরও তৃণমূল পর্যায়ে বছরজুড়ে কাজ করা।
প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করি। আমি সব সময় নিজে বাজার করি। তো, এই সপ্তাহে বৈশাখের বাজার করতে গেছি কারওয়ান বাজার। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে আমার তেমনি জনমত যাচাই করার একটা সাংবাদিকসুলভ প্রবণতা রয়েছে। বাজারে তরকারিওয়ালা, মুদি দোকানদারসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম কে কিভাবে বৈশাখ পালন করবেন সেটি নিয়ে। কয়েকজন বললেন গ্রামের বাড়িতে যাবেন মেলা দেখতে। আর কয়েকজন বললেন আগে বৈশাখ পালন করতেন কিন্তু ইদানিং করেন না। কারণ বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে তারা শুনেছেন যে, পহেলা বৈশাখ পালন করা ঠিক নয় । এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা এদের মধ্যে একটু একটু করে ছড়ানো হচ্ছে। এরা একেবারেই নিরীহ মানুষ। কোনো রাজনীতির সঙ্গে মোটেই যুক্ত নন। কিন্তু তারা যুক্ত না হলেও,সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কিভাবে তাদের মধ্যে অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। ওদের কথা শুনে মনে হলো, এত বছর ধরে তাহলে আমরা কি এমন কাজ করলাম যে এর বিপরীতে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে মৌলবাদীরা! আমরা তাহলে সকল শ্রেণিতে সকল স্তরে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে পারিনি।
বাঙালি ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তারচেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয় এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজে হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে বা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো’টি নেই।’ মানুষ পৃথিবীতে কোনো ধর্ম নিয়ে আসে না। কিন্তু গায়ের রং ও চেহারার নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। একজন নবজাতক জন্মমুহূর্ত থেকে যে ধর্মীয় অনুসারীর পরিবারে পালিত হবে সাধারণত সেই ধর্মই সে গ্রহণ করবে। মানুষ ধর্মকে পরিবর্তনও করতে পারে। হরহামেশাই আমরা দেখতে পাই কনভার্টেড হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। গায়ের রং, মুখের গঠন, করোটির গঠন পরিবর্তন করা যায় না। অপারেশনের মাধ্যমে করতে চাইলেও পরিণতি হয় মাইকেল জ্যাকসনের মতো। বিরূপ শারীরিক প্রতিক্রিয়া ওঠে চরমে।
যে দেশে যে ভাষিক গোষ্ঠির মধ্যে একজন বড় হয়, শৈশবে শেখা সেই ভাষায় সে যতটা দক্ষ হয় তা বড় হয়ে শেখা অন্য ভাষাতে আর আসে না। আমরা বাংলার মাটি, বাংলার জলে পরিপুষ্ট। এদেশের লোকজ ঐতিহ্য মিশে আছে আমাদের রক্তকণিকায়। আমাদের ধর্ম পালনের সঙ্গে এই ঐতিহ্যের কোন বিরোধ নেই। যে মৌলবাদীরা এই উৎসবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে তারা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায়। পহেলা বৈশাখের নববর্ষ পালন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। এই একটি দিনে বাংলাদেশের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসব পালন করেন। শুধু বাঙালি নয়, পাহাড়ি জনগোষ্ঠিও এই সময় বর্ষবরণের উৎসব করেন।
বাঙালির লোকজ উৎসবগুলো আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ধারণ করে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক রূপকে ধরে রাখতে হলে সমাজের সর্বস্তরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এদেশের প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে যখন সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকবে, তখন মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ধীরে ধীরে কমে যাবে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিটি সংগঠনের প্রয়োজন এখন এদিকে দৃষ্টি দেওয়া।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর