ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন কি?

প্রকাশিত: ০৬:০৫ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর নেতৃত্বদানকারী দেশগুলো এমনটাই ভেবেছিল যে, এরপর আর কোনো যুদ্ধ নয়, এবং সে জন্য যা যা করণীয় তাই-ই করা হবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেলো যে, কিছুদিন যেতে না যেতেই পৃথিবী এক শীতল যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। পৃথিবী সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক, এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে কয়েক দশক ধরে চালিয়ে গেছে এই যুদ্ধ। কোথাও ক্ষমতার, কোথাও অর্থনীতির, কোথাও না নিছক ছেলেমানুষি খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ভেতর দিয়ে এই শীতল যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধের অবসান ঘটে।

কোনো আনুষ্ঠানিক ও ঘোষিত যুদ্ধ না হলেও কয়েক দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে ৬ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে বলে গুগুল-এ প্রশ্ন করলে তার উত্তরে আপনি জানতে পারবেন। বিভিন্ন দেশকে কেন্দ্র করে যেমন লেবানন, ভিয়েতনাম, ইরাক-ইরান, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে একেকটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা বার বার শুনে আসছি যে, এই বুঝি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিষয়টি বহুবার আলোচনায় এসেছে। শেষতক পশ্চিমা পণ্ডিতরা বলেছেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ হবে না, বরং বিচ্ছিন্ন ভাবে বহুদিন ধরে এই যুদ্ধ বিভিন্ন দেশে চলবে (যেমন মধ্যপ্রাচ্য) এবং এটি মূলতঃ অর্থনৈতিক ভাবে শাসন-শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সে অর্থে আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর বসবাস করছি। কিন্তু হঠাৎই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যম ভিন্ন সুর গাইতে শুরু করেছে। এবং পশ্চিমা বিশ্লেষক, তাত্ত্বিক ও অধ্যাপকদের বরাত দিয়েই গণমাধ্যম বলতে চাইছে যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবেই শুরু হতে যাচ্ছে। এবং এবারের যুদ্ধ আসলে শুরু হবে এশিয়ায় ও তা ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। পাঠক নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বুঝতে পারছেন, আমি কোন্ যুদ্ধের কথা বলছি? না বুঝতে আরো একটু ব্যাখ্যা করি।

ধরুন আমরা যদি আমাদের নিজেদের দেশ, দেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎকে এড়িয়ে একটু বিশ্বের দিকে তাকাই (বাঙালির বিরুদ্ধে চিরকালের অভিযোগ তারা বহির্মুখি নয়, তারা ঘরকুনো। কথাটা যদিও সত্য বলে আমার মনে হয় না, কারণ বিদেশে বেরুনো মাত্র বাঙালি যে পরিমাণ কষ্ট করতে পারে তার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভই আমাদের বার বার দিয়ে চলেছে) তাহলে দেখতে পাই যে, স্নায়ু যুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধের অবসানান্তে পৃথিবীতে আবার বৃহৎ শক্তিবর্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তারে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং একটু কম হলেও ভারত, এই কয়েকটি দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতিকে জানান দিতে দেশে দেশে যেসব ক্রিয়াকর্ম শুরু করেছে তাতে বিশ্লেষকগণ একে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ আখ্যা দিয়েছে ২০১৪ সালে। বিশেষ করে তখন তিনটি এলাকায় এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।

এক. প্রথম স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত ও ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনকে যে মুহূর্তে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে সে মুহূর্তে একদিকে রাশিয়া ও আরেকদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আসলে জাতিসংঘকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল সেই এলাকায়।

দুই. ইরাক দখল ও দেশটিকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য সকল অস্ত্র প্রয়োগ করেও যখন সেখানে কোনো ধরনের পারমাণবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র পাওয়া গেলো না তখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবাজ মানুষগুলো ভাবলো, মধ্যপ্রাচ্যে আসলে আরো স্থায়ী ও শক্তিশালী কল্পিত শত্রু তৈরি করা না গেলে মধ্যপ্রাচ্যে বেশিদিন টেকা দায় হবে। কারণ পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সাধারণ মানুষই মধ্যপ্রাচ্যে এই অনৈতিক মানুষগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ততোধিক অনৈতিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এর মূল কারণ হলো বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশে যেসব যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ পর্যন্ত ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই ৪ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে বলে বিশ্লেষকগণ দাবি করছেন। যাহোক, ইরাক যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ এবং তার দেশ।

Koriaএকটি দুধের শিশুও জানে যে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার ও তার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা আসলে আর কিছুই নয় মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্যকে করায়ত্বে রাখা। মজার ব্যাপার হলো, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলি এই অন্যায় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সিরিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক যুদ্ধেই যেমন প্রয়োজন পড়ে একটি কাল্পনিক দৈত্য সৃষ্টির এবং তাকে দমনের নামে যুদ্ধে নামার জন্য জনমত তৈরি তাই এক্ষেত্রেও কথিত ইসলামিক স্টেটকে দাঁড় করানো, তাকে যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ এবং তাকে ক্রমাগত হিংস্র থেকে হিংস্রতর করে তোলার জন্য প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো সবই করা হয়েছে অত্যন্ত সুকৌশলে এবং এখন সিরিয়াকে একেবারে ধংস করে দেওয়ার পর কথিত আইএস দমনে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া, ইরান ও চীন সিরিয়ার পক্ষে দাঁড়ানোর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলিকে প্রায় শত্রুর কাতারে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন ও দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের ফ্রন্ট খুলেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

তিন. সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি যা বিশ্বের সকল মানুষকে ভীত করে তুলছে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ-আশঙ্কায় তাহলো এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন যুদ্ধজাহাজের অবস্থানকে কেন্দ্র করে। যদিও নব-নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলছেন যে, উত্তর কোরিয়াকে একটি শিক্ষা দেওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু কার্যত তিনি আসলে উত্তর কোরিয়াকে নয়, চীনকেই একটি শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠছেন বলে বোঝা যাচ্ছে। কারণ উত্তর কোরিয়ার শক্তিকেন্দ্র আসলে চীনকে কেন্দ্র করে এবং এখানে রাশিয়াও মিত্রশক্তির ভূমিকায় রয়েছে চীন ও উত্তর কোরিয়ার জন্য। ফলে কোরীয় উপদ্বীপের কাছাকাছি যখন পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন রণতরী এসে হাজির হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজনাটি চীনের মতো দেশেও বহুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ স্নায়ুযুদ্ধের বা ঠান্ডা যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশীয় অঞ্চলকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

কিন্তু সব শীতল যুদ্ধক্ষেত্রকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কারণ হিসেবে না বলে কেন কেবলমাত্র প্রশান্ত মহাসাগরের এই এশীয় এলাকাটি অর্থাৎ উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করেই সৃষ্ট পারমাণবিক-উত্তেজনাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে? কারণ অর্থনৈতিক ভাবে চীনা-শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেও চীনের আধিপত্য কোথাও মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। পণ্ডিত স্যামুয়েল হান্টিংটন তার ‘এন্ড অব সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা নন-ইসলামিক পক্ষটি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমানদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এই বেদুইন ধর্মের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে জন্মানো খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে দেখিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-তাত্ত্বিকগণ এবং রাষ্ট্রের ভেতরকার যুদ্ধংদেহী মনোভাবের জেনারেল বা রাজনীতিবিদদের পরামর্শকগণ আসলে কেবলমাত্র মুসলমানদেরকে শত্রু হিসেবে দেখছে না, তারা মনে করছে, কোনো না কোনো ভাবে চীনকেও যদি এই শত্রু তালিকায় ফেলে দাবিয়ে রাখা যায় তাহলে গোটা বিশ্বই তাদের করতলে চলে আসবে। যে কারণে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক মিত্র তৈরি করে প্রশান্ত মহাসাগরী এশীয় অঞ্চলকে বসে রাখার চেষ্টা চলছে বিগত কয়েক দশক ধরে। কিন্তু তাতে চীনের কোনো অসুবিধে হয়নি, তারা এগিয়ে গেছে অর্থনৈতিক ভাবে, ফলে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে যদি একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা না যায় তাহলে আসলে এশিয়াতে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আর সে লক্ষ্যেই নতুন করে যুদ্ধ-উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এলাকায় এবং এই উত্তেজনার আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢেলেছে উত্তর কোরিয়ার পাগলা-রাজা কিম দে জং। ফলে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন রণতরীর প্রবেশ ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মিসাইল পরীক্ষা যে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে তাকেই যুদ্ধ-বিশ্লেষকগণ বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর হাতছানি এবং তাদের মতে, এবার এই যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব হবে এ কারণে যে, কোনো পক্ষই বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত নয় আর।

কিন্তু একথাতো সত্যই যে, বিশ্বময় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমাগত ভেঙে-চুরে গিয়ে দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মানবিক অর্থনীতির বদলে গড়ে উঠেছে যুদ্ধ-নির্ভর অর্থনীতি এবং একে বাঁচিয়ে রাখতেই এখন যুদ্ধ বাঁধানো একেবারেই জরুরি হয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ওয়ার-ইন্ডাস্ট্রি নির্ভর দেশের জন্য। যুদ্ধের অনুপস্থিতিই যে শান্তি নয়, একথা যারা শান্তি ও সংঘর্ষ নিয়ে পড়েন তাদেরকে প্রাথমিক বেদবাক্য হিসেবে পড়ানো হয়ে থাকে। মার্কিন রণতরীর কোরীয় উপদ্বীপে প্রবেশ ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা যে উত্তেজনা জন্ম দিয়েছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও বাংলাদেশের মতো দূর প্রতিবেশি দেশেও পশ্চিমা দূতাবাসগুলি থেকে তাদের নাগরিকদের জন্য অলিখিত সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে বলে জানা গেছে এবং যুদ্ধ যদি সত্যিই বেঁধে যায় তাহলে তারা কোথায় কোথায় জড়ো হলে সেখান থেকে তাদেরকে দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় সেসকল স্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

আজকের লেখাটি মূলতঃ এই যুদ্ধ-ভয় থেকেই লেখা যা আসলে এই পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার নিমিত্তে গৃহীত পদক্ষেপ থেকেই মাথায় এসেছিল, নাহলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশীয় অঞ্চলে কী হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা আছে বলেতো মনে হয় না, বরং আমরা আমাদের দেশজ রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম বেশ!!
ঢাকা ১৮ এপ্রিল, মঙ্গলবার ২০১৭

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন