সিটিং সার্ভিস, চিটিং সার্ভিস
গত এক যুগ ধরে আমার ঢাকার পাবলিক বাসে চড়া হয় না। এক যুগ বয়সী ব্যাকপেইন আমার পাবলিক বাসে চড়ার সামর্থ্য কেড়ে নিয়েছে। তবে তার আগে ঢাকায় দেড় যুগ পাবলিক বাসের ডেইলি প্যাসেঞ্জার ছিলাম আমি। শুধু ঢাকায় নয়, ছেলেবেলা থেকেই আমি লোকাল বাসের নিয়মিত যাত্রী। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমি ভর্তি হই গৌরীপুর সুবল-আফতাব উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমাদের বাড়ি থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে চার কিলোমিটার গিয়ে পেন্নাই বাসস্ট্যান্ডে নেমে আরো দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতে হতো স্কুলে। প্রতিদিন স্কুলে যেতে-আসতে আমাদের লোকাল বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো। লোকাল বাস ছাড়া অন্য কেউ ছাত্রদের তুলতো না।
ঢাকায় এসে আমার লোকাল বাসনির্ভরতা আরো বাড়ে। কীভাবে কম খরচে ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাওয়া যায়, কীভাবে ভিড়ের বাসে কাঞ্চি মেরে ওঠা যায়, কীভাবে কয়েকটা আঙুল পাদানিতে রেখে রড ধরে ঝুলে থাকা যায়; তার অ্যাক্রোবেটিক দক্ষতা অর্জন করেছিলাম আমি। একবার মনে আছে গুলিস্তান থেকে বাসে ঝুলে জগন্নাথ কলেজে গিয়েছি। সেদিন আমার পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার হলে ঢুকে আধঘণ্টা বাম হাত দিয়ে ডান হাত ম্যাসেজ করতে হয়েছিল। কারণ ঝুলে থাকতে থাকতে আমার ডান হাত অসার হয়ে গিয়েছিল।
অনেক দিন না উঠলেও লোকাল বাসের জার্নি আমি খুব মিস করি। লোকাল বাস মানেই যেন একটা বাংলাদেশ। মিরপুর থেকে গুলিস্তান যেতে যেতে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি; মানুষের সহিষ্ণুতা, অসহিষ্ণুতা সব জানা হয়ে যেত। ছাত্র বা স্টাফের হাফ ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে তর্কাতর্কি, মারামারি তো নিত্যদিনের ঘটনা। ভোরের কাগজে একসময় চিড়িয়াখানায় বাঘের মৃত্যু নিয়ে আলোচিত রিপোর্ট করেছিলেন সুপন রায়। বাঘের মৃত্যুর খবরটি প্রথম পিন্টু (জায়েদুল আহসান) পেয়েছিলেন লোকাল বাসে, যাত্রাবাড়ী থেকে বাংলামোটর আসার পথে।
ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ। আপনারা বলতে পারেন, আপনি কয়টি দেশ দেখেছেন, যে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বলে দিলেন। এটা ঠিক, আমি খুব বেশি দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা দেখিনি। তবু সবচেয়ে খারাপ বলছি, কারণ এর চেয়ে খারাপ হওয়া সম্ভব নয়। হ-য-ব-র-ল, নৈরাজ্য, দুর্ভোগ- যত নেতিবাচক শব্দ আছে; সব খাপের খাপ মিলে যায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। বাসের কথায় পরে আসছি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলার আর ট্যাক্সিক্যাবে মিটারে ভাড়া নেয়ার সামান্য বিষয়টি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অধিকাংশ সিএনজি বা ক্যাব যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যেতে চান না। আর গেলেও ভাড়া দিতে হয় তাদের ইচ্ছামতো। ঢাকায় মানুষ বেশি, রাস্তা কম, গণপরিবহন আরো কম।
আমার বাসে চড়ার শেষ সময়ে সিটিং সার্ভিস, গেটলক- নানা বাহারি নামের নানা সার্ভিস চালু হয়। কিন্তু নামের সাথে কাজের মিল ছিল না। তাই মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাসের গায়ে লেখা থাকতো ‘আল্লার কসম গেটলক’, ‘মায়ের কসম গেটলক’। কিন্তু কথায় তো আর মানুষ বিশ্বাস করে না, কাজে বিশ্বাস করাতে হয়। মানুষ সিটিং সার্ভিসকে বলতো ‘চিটিং সার্ভিস’। এসবই ছিল নিছক বাড়তি ভাড়া আদায়ের বাহানা। সকালে অফিস টাইমে গেটলক, পরে জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হতো। তবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয় বলে শুনেছি। আমার দুর্ভাগ্য, এই উন্নতিটা ভোগ করার সুযোগ হয়নি। তবে যখন দেখতাম বিভিন্ন কাউন্টারের সামনে মানুষের লম্বা লাইন দেখে ভালো লাগে। ভালোও লাগে আবার কষ্টও হয়। ইশ, আমাদের সময় কেন যে এমন সার্ভিস ছিল না।
একটা খুব ব্যক্তিগত কষ্টের কথা মনে পড়ে। বছর বিশেক আগে হবে। আমার বাসা তখন মিরপুরে। আব্বা খুব অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে গ্রিন রোডে ডাক্তার দেখিয়ে অনেক কষ্টে ফার্মগেটে আসি বাসায় যাবো বলে। কিন্তু এসেই পড়ি জনসমুদ্রে। একেকটা বাস আসে আর মানুষ মৌমাছির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি একা হলে সেই ঝাঁকে মিশে যেতে পারতাম। কিন্তু অসুস্থ আব্বাকে নিয়ে সেই বাসে ওঠা সম্ভব ছিল না। রিকশা, ট্যাক্সি, টেম্পো কিছুই পাচ্ছিলাম না। নিজেকে খুব অসহায় আর ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। অসুস্থ পিতাকে একটু আরাম দেয়া তো দূরের কথা, বাসায় নিতেই সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছিল। আজ যখন গাড়ি চড়ি বা বাসের কাউন্টারের সামনে সুশৃঙ্খল লাইন দেখি, সেই কষ্টটা ফিরে আসে। তবে বাংলাদেশের মানুষ লাইন ধরে বাসে উঠছে, বাসে আসনের বেশি যাত্রী নেই, বাস যেখানে সেখানে থামিয়ে লোক তুলছে না; দেখে সত্যি ভালোই লেগেছে আমার।
হঠাৎ শুনি সব সিটিং, গেটলক, স্পেশাল সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হবে। সব হবে লোকাল সার্ভিস। বাস মালিকরাই এ প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকারও তাতে সায় দিয়ে বিশেষ আদালত নিয়ে রাস্তায় নেমেছে সব সার্ভিস বন্ধ করতে। শুনে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। সিটিং, স্পেশাল বা গেটলক সার্ভিসে সমস্যা কোথায়? শুনতে অবশ্য খারাপ লাগে না। গণপরিবহনে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সবাই এক সার্ভিস পাবে। আগে তো সার্ভিসটা নিশ্চিত করতে হবে, তারপর না বৈষম্য ঘোচানোর চেষ্টা। আর সমাজের পদে পদে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন বৈষম্যের উৎকট, অশ্লীল প্রকাশ; তখন গণপরিবহনে বৈষম্য দূর করতে সবার এমন চেষ্টা! বারে বাহ।
সিটিং, স্পেশাল, গেটলক সার্ভিস বন্ধের প্রস্তাবটা মালিকপক্ষের। তাদের যুক্তি, অফিস টাইমে যখন সিটিং সার্ভিস নির্ধারিত আসনের যাত্রী নিয়ে চলে যায়, তখন আরো অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের কথা ভেবেই নাকি বাস মালিকদের এমন প্রস্তাব, যাতে সায় দিয়েছে সরকারও। কী আশ্চর্য, মালিকরা হঠাৎ এমন জনদরদি হয়ে উঠলেন কবে থেকে, কেন? এই কেন’র উত্তর পুরোটা এখনও জানি না। তবে যতটুকু জেনেছি, সিটিং, স্পেশাল বা গেটলক সার্ভিসের জন্য সরকার নির্ধারিত আলাদা ভাড়ার তালিকা নেই। বাস চালক-হেলপাররা মিলে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে, যার পুরোটা পায় না মালিকপক্ষ। তাই পরিবহন শ্রমিকদের শায়েস্তা করতেই মোবাইল কোর্ট নিয়ে মাঠে নেমেছে মালিকপক্ষ।
মালিকপক্ষের আসল দাবি হলো, বিশেষ সার্ভিসের জন্য সরকারের কাছ থেকে বিশেষ ভাড়ার তালিকা আদায় করা, তখন সিটিং-স্পেশাল-গেটলক থেকে বাড়তি টাকাটা পাবে মালিকপক্ষ। কৌশলে মালিকপক্ষ, তাদের দাবি আদায়ে সরকারকে সাথে নিতে পেরেছে। আমি নিশ্চিত, বিশেষ সার্ভিস বন্ধের কারণে জনগণের যে দুর্ভোগ তা দেখিয়ে এই সার্ভিসটি শিগগিরই আবার চালু হবে, সরকার নির্ধারিত বাড়তি ভাড়াসহ। বাংলাদেশে সবাই সব দাবি আদায়ে সবসময় জিম্মি করে জনগণকে। সেটা বাস চালক হোক, মালিক হোক, সাংবাদিক হোক, ডাক্তার হোক।
সিটিং-স্পেশাল-গেটলক সার্ভিস বন্ধের একমাত্র যুক্তি হলো জনগণের ভোগান্তি দূর করা। কিন্তু বিশেষ সার্ভিস বন্ধের পর দুর্ভোগটা কাদের হচ্ছে? শুধুমাত্র জনগণের। হা হা হা। জনগণের জন্য মালিকপক্ষের দরদ দেখে আমার খালি একটি কথাই মনে হচ্ছে, মাছের মায়ের পুত্রশোক। গণপরিবহনে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস থাকতে অসুবিধা কোথায়, বুঝি না। বিশ্বের সব দেশের, সব খাতে, সব সার্ভিসে আলাদা আলাদা সার্ভিস আছে। বিমান, ট্রেন, লঞ্চ সর্বত্র বিভিন্ন শ্রেণি আছে। ঢাকার গণপরিবহনে আলাদা সার্ভিস থাকতেও অসুবিধা নেই। যিনি কম টাকায় যেতে চান, তিনি লোকাল বাসে যাবেন; যিনি আরামে যেতে চাইবেন, তিনি বাড়তি ভাড়া দেবেন। সোজা হিসাব। স্পেশাল সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় কারো লাভ হয়নি; দুর্ভোগে পড়েছেন নারী, শিশু আর বৃদ্ধরা। আগে লাইনে ধরে নারী-শিশু-বৃদ্ধরা দেরিতে হলেও গাড়িতে উঠতে পারতেন, উঠে আসন পেতেন। কিন্তু নিজের বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অফিস টাইমে লোকাল বাসে নারী-শিশু-বৃদ্ধদের ওঠা আর এভারেস্ট জয় করা সমান কথা। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে আমার যে তিক্ত ও কষ্টকর অভিজ্ঞতা; প্রতিদিন কারো না কারো সে অভিজ্ঞতা হবে।
সরকার কদিন আগে বাসে নারীদের জন্য নির্ধারিত সিটে পুরুষরা বসলে শাস্তির বিধান রেখে আইন করেছে। শুনে হাসি আসে। আগে তো নারীদের বাসে উঠতে হবে, তারপর না নির্ধারিত আসন। এভারেস্ট জয় কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের দুজন নারী এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন। তাই এত কষ্ট হলেও কর্মজীবী নারীদের অনেকে বেপরোয়া ভাবে লোকাল বাসে ওঠে পড়েন। ঠাসা বাসে উঠে পড়া একজন নারীকে যে কী ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ঢাকার লোকাল বাসের যাত্রী একজন নারী আসলে প্রতিদিন মরে যান। প্রতিদিন রাতে বাসায় ফেরেন তারা পুরুষ জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা আর শরীরে বিবমিষা নিয়ে। সিটিং সার্ভিস হওয়ায় এই নারীরা, বৃদ্ধরা, শিশুরা একটু আরাম পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আরামটা কারো কারো সইলো না। সবচেয়ে মজার কথা হলো, সিটিং-স্পেশাল-গেটলক সার্ভিস বন্ধ হলেও ভাড়া কিন্তু আগের মতোই আছে। সবাই তাই বলছেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধের নামে যা করা হচ্ছে, তা আসলে জনগণের সাথে চিটিংমাত্র।
সিটিং-স্পেশাল-গেটলক সার্ভিসের জন্য যদি সত্যিই জনগণের অসুবিধা হয়, সরকার এবং মালিকপক্ষ যদি সত্যিই জনগণের ভালো চান; তাহলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন; আরো বেশি করে গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করুন, বিআরটিসিকে সক্রিয় করুন। তা না করে বিশেষ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া কোনো কাজের কথা নয়। পায়ে ধুলা না লাগাতে চাইলে চামড়া দিয়ে নিজের পা মুড়িয়ে দিলেই হয়, জগৎ ধুলায় অন্ধকার বা কাদাময় করে ফেলা কোনো সমাধান নয়। যেমন মাথা কেটে ফেলা, সমাধান নয় মাথাব্যথার।
ওবায়দুল কাদের অনেক সক্রিয় মন্ত্রী। রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে তিনি জনগণের সমস্যার কথা শোনেন, তাৎক্ষণিক সমাধান দেন। অনুরোধ জানাচ্ছি, তিনি যেন, ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার ব্যবস্থা করেন, যাতে মানুষ একটু আরাম পায়।
১৭ এপ্রিল, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/এমএস