ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ

প্রকাশিত: ০৭:০৪ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

"প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। 

কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ!"

বাংলা মাসের কত তারিখ আজ? বাংলা মাসের হিসাব এখন আর আমরা বাঙালিরা রাখি না। ষড়ঢঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বঙ্গদেশের জলবায়ুকে ষড়ঋতুর ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। বছর ঘুরে আসে এই ছয়টি ঋতু। এগুলো হচ্ছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত এবং শীত ঋতুর সাথে বর্ষা ও শরৎ ঋতু। বাংলা সনের মাসগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই ঋতু বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিটি ঋতুতে নানা গন্ধ, বর্ণের ফুলের সৌরভে সুবাসিত হয়ে থাকে এদেশের মাঠ, ঘাট, বাড়ির আঙিনা। বঙ্গদেশের ঋতু বৈচিত্রকে ধারণ করবার কারণে বাংলা সনের জনপ্রিয়তা এসেছে।

গ্রীষ্ম ষড়ঋতুর প্রথম ও বসন্ত ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্ত ঋতু। বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটে শীত চলে যাবার পর এবং গ্রীষ্ম আসার আগে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে কারণ পৃথিবী সূর্যের দিকে হেলে থাকে। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এই ঋতুতে ফুল ফুটে, গাছে নতুন পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। প্রকৃতির সাথে প্রতিটি মানুষের এক রহস্যময় অলৌকিক অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে যা হয়তো তার নিজের অলক্ষ্যে তারই অস্তিত্বের সাক্ষর বহন করে চলেছে। তাই হয়তো কালের প্রবাহে ধীরে ধীরে এই ধরণী মা’ই তাঁকে আবার কাছে টেনে নেয়। ধরণী মায়ের রাঙা ঋতু বসন্তের শেষে ও গ্রীষ্মের শুরুতে ফোটা একটি অসাধারণ কাব্যময় ফুলের কথা মনে পড়ে গেলো। সে ফুলগুলো নাকি ভারি রসিক। একটাই আবদার তাদের, কোন সুন্দরী তার ছোট্ট, সুন্দর পা দিয়ে গাছটিকে আঘাত না করলে তার ফুলগুলো ফুটবেই না।

কি এই ফুলের নাম? রাবণ সীতাকে চুরি করে লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে কোন কাননে বন্দী করে রেখেছিলো? "অশোক কাননে", হ্যাঁ এই ফুল "অশোক ফুল"। "অশোক" অর্থ "শোক নেই", অর্থাৎ আনন্দ। অশোক সেই ফুল, যা দেখলে মন আনন্দে ভরে ওঠে এর সৌন্দর্যে, বৈভবে ও রাজকীয় প্রস্ফুটনে। গাছটির কুড়ি ও ডালপালা থেকে লাল ও হলুদ রঙের থোকা থোকা ফুল বেরোয়। গাছটি ছায়াঘন ও যেকোন বাগানের অনিন্দম ঐশ্বর্য। কেমন হোতো আমাদের সকলের বাড়ির আঙিনায় যদি থাকতো এমন একটি অশোক গাছ? আমাদের সকল শোক হরণ করে নিতো পারতো যদি সেই ঐশ্বর্যময়ী অশোক গাছটি!!

কিন্তু মানুষের শোক যেমন চিরস্থায়ী নয়, সুখ, দুঃখের অবসান আছে, তেমনি অশোক ফুল আর বসন্ত ঋতুর ও অবসান হয়। বসন্ত ঋতু শেষেই আসে গ্রীষ্ম। গ্রীষ্ম হলো বছরের উষ্ণতম ঋতু, যা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থান করে। এই সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভূমি, পানি শুকিয়ে যায়, অনেক নদীই নাব্য হারায়, জলশূন্য মাটিতে ধরে ফাটল। গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ্বে সন্ধ্যাসমাগত সময়ে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তথা বাংলাদেশে এসময় গাছে গাছে বিভিন্ন মৌসুমী ফল দেখা যায়, যেমন: আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি।

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ জুড়ে গ্রীষ্মকাল। পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম মাস। বৈশাখ ষড় ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীষ্মের প্রথম মাস। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে বাঙালি-জীবনে নতুন বছরের সূচনা। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে ওঠে উৎসবে মুখরিত। বাঙালী মানেই উৎসব, তথা "বারো মাসে তেরো পার্বণ।" তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া সে বৃহৎ।" রবীন্দ্রনাথ নববর্ষ উৎসবে নতুন মাত্রা এনেছিলেন। দিনটি ছিল তাঁর কাছে সুপ্তির অন্ধকার থেকে নব জাগরণের দিন। এ কথা তাঁর বহু লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। নববর্ষ উৎসব পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় হতে থাকে স্বদেশ চেতনার জাগরণ কালে এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কিছু বছর আগে থেকে। পরে শান্তিনিকেতনে পহেলা বৈশাখ পালন করা হত কবির জন্মদিনে।

বাঙালি সংস্কৃতিতে বাংলা সনের ব্যবহার এখন আর পূর্বের পর্যায়ে নেই। নাগরিক জীবন যাপনের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় এর ব্যবহার এখন কেবল কৃষিজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কৃষিজীবীরা এখনো বীজতলা তৈরি, বীজ বপন, ফসলের যত্ন, ফসল তোলা ইত্যাদি যাবতীয় কাজে বাংলা মাসের ব্যাপক ব্যবহার করেন।

হিন্দু সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সামজিক অনুষ্ঠানগুলো, যেমন বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, জামাই ষষ্ঠী, ভাই ফোঁটা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচনে বাংলা মাসের দিনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎসব পার্বণ যেমন পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এগুলোও বাংলা মাস নির্ভর। শহরে মানুষরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সাম্প্রতিক কালে পহেলা বৈশাখকে একটি সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ দিতে সচেষ্ট এবং অনেকখানি সফলও বলা যায়।

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে। সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে এদিন উদযাপন করা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল ১৪ তারিখে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তা উদযাপন করা হয় সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। এটি পাশ্চাত্যের বর্ষপঞ্জির মতন নির্দিষ্ট নয়। ভারতের বাঙালিরা নতুন বছর উদযাপন করে এপ্রিল ১৪ বা ১৫ তারিখে। ভারতের সমস্ত বঙ্গভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে সনাতন নিরয়ণ (জ্যোর্তিমণ্ডলে তারার অবস্থানের প্রেক্ষিতে গণিত, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর প্রকৃত সময়ই নিরয়ণ বর্ষপঞ্জি) বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বর্ষপঞ্জি ক্রান্তীয় বা সায়ন বর্ষপঞ্জি (যেমন সংস্কারকৃত বাংলা সন এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি) থেকে ভিন্ন। এই উভয় ধরনের বর্ষপঞ্জির মধ্যে সময়ের যে গাণিতিক পার্থক্য রয়েছে তার কারণেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নতুন বর্ষ শুরুতে দিনের পার্থক্য হয়।

ইতিহাস বলে বাংলায় নববর্ষ উৎসবের প্রচলন হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।

একটি সমাজের বিচিত্র মানুষের আত্মিক ও বস্তুতান্ত্রিক তারতম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, তাদের চিন্তা-চেতনা, তাদের অনুভূতিগত বৈচিত্র- ইত্যাদি সবকিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি। অর্থাৎ সংস্কৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনের বিচিত্র অবস্থা, মানুষের মানবিক অধিকার, তাদের মূল্যবোধের ধারা, তাদের আবহমান ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদি। আশেপাশের পৃথিবীর ব্যাপারে মানুষের মাঝে যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সংস্কৃতি সেগুলোকে দিক-নির্দেশনা দেয় এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যগুলোকে সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে। সংস্কৃতি মানুষকে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ জীবন দান করে, বিবেচনা শক্তি দেয় এবং মানুষের মাঝে নৈতিকতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সংস্কৃতির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধের শিক্ষা পাই এবং নিজেকে অন্যদের মাঝে পরিচিত করে তোলার সুযোগ পাই কিংবা নিজেদের মধ্যকার সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করার সুযোগ পাই। এই সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী সংস্কৃতি একটি সমাজের নির্দিষ্ট স্বরূপ নির্ণয় করে এবং মূল্যবোধ, বিশ্বাস, শিল্প-সাহিত্য এবং সাধারণ আচার-আচরণ পদ্ধতিগুলোর উপাদান গঠনে সহযোগিতা করে।

এই যে মূল্যবোধের কথা বলা হলো, এই যে ঐতিহ্যের কথা বলা হলো, এগুলো শিল্পের বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং ধীরে ধীরে সবার কাছে পরিচিত হয়ে পড়ে। এভাবেই একটি জাতির শিল্প, তাদের ঐতিহ্য ও রীতি-আচারগুলোর সাথে পরিচিত হবার প্রভাবশালী একটি মাধ্যমে পরিণত হয় সংস্কৃতি। বাঙালি হিসেবে নিজেকে এবং নিজের সংস্কৃতজ্ঞ মন মানসিকতাকে তখনই সংকুচিত মনে হয় যখন দেখি চারদিকে পুলিশ-র্যা বের তিন-চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান করছে বাঙালি সংস্কৃতি এখন। ছায়ানট, উদীচী ইত্যাদির মতো কিছু শিল্প-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফুরান প্রাণের জোয়ারে যদি না ভেসে যেত রমনার বটমূল, বকুলতলাসহ আরো অনেক জায়গা, তাহলে কী হতো বাংলাদেশের বাঙালিত্বের? চোখে পড়ার মতো কিছু থাকত কি তার?

মুখে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বলে বলে ফেনা উঠিয়ে ফেললেও কোনো কাজ হবে না অন্তরে তার সঙ্গে সততা যুক্ত না হলে। এসব সমস্যার সমাধান লাভ করা যায় সহজে একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতির আন্তরিক নিবিড় চর্চা ও সেবার মধ্য দিয়ে। কারণ বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির সে ঐতিহ্য-শক্তি রয়েছে। গৌড় নামে বা গৌড়ের মধ্যে হোক, বা আলাদাভাবে হোক, `বঙ্গ` নামে একটি অঞ্চলের নাম চলে আসছে সুদূর বৈদিক যুগ থেকেই। যদি ধরে নিই একাত্তরে তারই অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন `বাংলাদেশ` নামে, তাহলে তেমন কাল্পনিক কিছু বলা হবে না।

সেকালের সুহ্ম, সমতট, গৌড়, বরেন্দ্রী, বঙ্গ ইত্যাদি অঞ্চলের কম-বেশি মানুষ যারা ঘনীভূত হয়েছেন বিশেষত বঙ্গ অঞ্চলে, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে তারাই পরবর্তীকালে `বাঙালি` নামে পরিচিত হন। আবার এমন মতও রয়েছে- গৌড়, বরেন্দ্রী, বঙ্গ ইত্যাদি জনপদ মিলে যে বৃহত্তর জনপদ গড়ে ওঠে তারই নাম হয়েছে আবার `বঙ্গ`। সে বঙ্গের অধিবাসীরাই হলেন `বাঙালি`। স্থান, পরিচয় ও আগমন ভেদে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সম্মিলনে তৈরি হয়েছে এ বাঙালি জাতি। এ জাতির রক্তে রয়েছে আর্য, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচীনা, সেমিটিক রক্ত। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় বা অন্য কোনো পরিচয় দ্বারা যত বিভক্তিই তৈরি হোক না কেন এ সমাজে, শুনতে বিরক্তিকর মনে হলেও অনেকের কাছে, রক্তের একটি ঐক্য বা আত্মীয়তা রয়েছে অন্তর্লীনভাবে প্রায় সবার মধ্যেই। একে আবিষ্কারের মোক্ষম উপায় হলো অত্যন্ত আন্তরিক ও আয়তভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এবং সেই সঙ্গে ক্রমাগত বাঙালি সংস্কৃতির জীবিত-মৃত যাবতীয় ঐতিহ্যের উদ্ঘাটন উন্মোচন, যথাসময়ে যথাস্থানে সেগুলোর পালন।

স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রতিবাদে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫ সালে) রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সালের পর থেকেই মূলত এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এই উৎসবকে আরো এক ধাপ বাড়তি রংয়ের ছোঁয়া দিতে প্রচলন হয়েছে বৈশাখী শোভাযাত্রার।

এছাড়া এইদিনে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, নজরুল একাডেমী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই উদযাপন করে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান বৈশাখী মেলা। কোনো কোনো জায়গায় এই মেলা চলে পুরো সপ্তাহ জুড়ে। এক হিসেবে দেখা গেছে, সারা বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২০০টি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পান্তা- ইলিশ বৈশাখী মেলার প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সব জেলায়।

এসব মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগীতি ও লোকনৃত্য পরিবেশন করা হয়। সেখানে পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গান তো থাকেই, থাকে যাত্রাপালার আয়োজনও। কোথাও কোথাও পথনাট্য উৎসবও হয়ে থাকে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, সার্কাস বৈশাখী মেলার বিশেষ আকর্ষণ। শিশু- কিশোরদের জন্য আরো থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজেও এখন আয়োজিত হয় বৈশাখী মেলা। সবচেয়ে রঙচঙে ও আনন্দঘন নববর্ষ উদযাপিত হয় ঢাকায়। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় রমনার বটমূলে। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের আগমনী গান গেয়ে স্বাগত জানান নববর্ষকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সম্প্রতি বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে বই। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি শহরে নববর্ষ উপলক্ষে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমির বইয়ের আড়ং এসব বইমেলার মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অঞ্চলে বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা আয়োজন করেন ‘বৈসাবি’। চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বিজু, মারমাদের সাংগ্রাইং, আর ত্রিপুরাদের বৈসুক। বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু- এই তিনটির নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বৈসাবি শব্দটি। তাই ওই অঞ্চলের বর্ষবরণ উৎসবকে একসঙ্গে এখন বলা হয় বৈসাবি। বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন, এই তিনদিন মিলেই বৈসাবির মূল আয়োজন। পুরনো বছরকে বিদায় দিতে এবং নতুন বছরকে বরণ করতে সেই আদি কাল থেকেই পালন করে আসছে পাহাড়িরা এই উৎসব। এদিন তারা বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী মেলার আয়োজন করে।

ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মানুষ কিছু আনন্দ এবং স্মৃতিকে আপন করে নেয়। আর এ আপন করে নেওয়ার বিভিন্ন স্তর এবং সময়ের পথ ধরে সংস্কৃতির বিকাশ। প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় তার নিজস্ব অনুভূতি এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এ স্মৃতিময় জীবনের মাঝেই বাঙালি জাতি খুঁজে পায় এক নতুন জীবনের আস্বাদ, জীবন চলার পথের উপাদান, প্রেরণা আর উদ্দীপনা। বাঙালি জাতি হিসেবে, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রধান উৎসব হল পহেলা বৈশাখ।

লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন