নারীর চরিত্রহননই পুরুষের শেষ অস্ত্র
অশ্লীলতার ডাস্টবিনে বসে পপকর্ণ খাচ্ছি বেশ ক’দিন ধরে। শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া, লেখাপড়ায় লবডংকা, মগজের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া নষ্ট, ভ্রষ্ট পুরুষের বিকার ছড়িয়ে পড়েছে ব্যক্তি সাদিয়ার চরিত্রহননে। কারণ, ওদের চাইতে ভালো কেউ জানে না, যে মেয়েকে মগজ দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না, শক্তি দেখিয়ে থামানো যায় না, কুৎসা রটিয়ে দমানো যায় না, সে মেয়ে কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই একাট্টা হয়ে সর্বস্ব দিয়ে দুর্গন্ধ মুখ খুলে দিয়ে যা পারে তাই বলছে। একা না পারলে তাদের সেবাদাসী নারীদের দলে নিয়ে তাদের দিয়েও বলাচ্ছে। তবে খুব যে নতুন কিছু বলছে তা কিন্তু না। যুগে যুগে পুরুষরা মেয়েদের ভয় পেলে যা বলে তা-ই। সেই সব পুরোনো, চর্বিত চর্বন।
আমার চাইতে ভালো আর কে জানে এই পুরুষের সমাজ নারীর সাহস হজম করতে পারেনা, নারীকে কর্ষণের জন্য লাঙ্গল জোয়ালেরও অভাব তাই হয় না। যে মেয়ে পুরুষের নিয়মে চলা এই সমাজকে উপেক্ষা করে নিজের সমাজ নিজে তৈরি করে নেয়, নিজের জীবনের সুতো কোন পুরুষের হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজের হাতে রাখে পুরুষের এই সমাজ তাকে নষ্টা বলে, বেশ্যা বলে, বেয়াদব বলে। রাতের আঁধারে মুখে গামছা বেঁধে পতিতাপল্লী ঘুরে আসা পুরুষ পতিতের দল দিনের আলোয় বুক চিতিয়ে মেয়েদের বেশ্যা বলে গালি দেয়, নিজের পশ্চাৎদেশের ঘা লুকোতে। মণ্ডল পাড়ার মণ্ডলদের মতো নিরাপদ দূরত্বে থেকে, লুঙ্গির গোছা ধরে, পানের পিক ফেলতে ফেলতে দোকানে, হাটে বাজারে ঘুরে ঘুরে চরিত্রের মুণ্ডুপাত করে কুৎসা রটানো ছাড়া ‘হেড়ম’ দেখানোর কিইবা আছে এই অথর্ব পুরুষদের আর! নারীর চরিত্রহননই যুগে যুগে অক্ষম পুরুষের শেষ অস্ত্র, সে আর কে না জানে! ওদের ক্ষমতা তো ওইটুকুই।
অশিক্ষিত মূর্খের দল ভেবেছে নষ্টা বললেই, বেশ্যা বললেই বুঝি আঁচল বিছিয়ে কাঁদতে বসবো আমি। কিন্তু ওরা জানে না, আমি আগুন গিলে অঙ্গার প্রসব করতে শিখে গেছি সেই শৈশবেই। তাই শত্রুর মুখে ছাই ঢেলে আমি জোরে, আরো জোরে ঠা ঠা করে হাসি। আমি কলকল করতে করতে পাড়ার এ মাথা ও মাথা দাবড়িয়ে বেড়াই। আমার হাসির শব্দে ওদের পিলে চমকে যায়, ওরা বুঝতে দেয় না, কিন্তু আমি জানি, যায়। ওরা কাতর হয়ে আরো খারাপ কথা বলে। অথর্ব পুরুষের খিস্তি খেউর আমাকে ছাড়িয়ে আমার মা, মা’কে ছাড়িয়ে তাঁর মা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমি উপভোগ করি ওদের নিস্ফল আস্ফালন। চোখ, কান, নাক সবই খোলা রেখে দেখে যাই, শুনে যাই, আর হেসে যাই। অন্যজন আমাকে নিয়ে খিস্তি করছে বলে আমার লজ্জিত হবার বিন্দুমাত্র কোন কারণ আমি দেখিনা। বৃক্ষ তার ফলেই নিজ পরিচয় দেয়। ওরাও তাই করছে। এর মাঝে আমার যা করার তা করে যেতে থাকি আমার মতোই।
ইতিহাস সাক্ষী, যে মেয়েকে পুরুষরা ভয় পেয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছে তাকেই ডাইনি বলেছে, বেশ্যা বলেছে, নষ্টা বলেছে। তাই রাম থেকে রহিম সবাই এক ও একাট্টা এখানে। আধুনিক ইউরোপের প্রথম দিকে অসংখ্য প্রতিবাদী ও প্রথাবিরোধী মেয়েকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছে, কিংবা দেশান্তরিত করেছে, জিহ্বা কেটে নিয়েছে শুধু পুরুষ নিজেকে তাদের সমকক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে। জোহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক আনিয়া লুম্বা “রেনেসাঁ” নাটক নিয়ে তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোন নারী চরিত্রের মধ্যে সামান্যতম প্রতিবাদ বা প্রচলিত নিয়ম ভাঙার প্রবণতা দেখতে পেলেই তাকে রাষ্ট্র, সমাজ বা পরিবার শাস্তি দিয়েছে। সাহিত্যের আন্তিগানে, ডেসডিমোনা কিংবা চন্দরা, অথবা বাস্তবের খনা থেকে সুলতানা রাজিয়া কিংবা রোকেয়া থেকে আজকের তসলিমা কে বাদ পড়েছে এই শাস্তি থেকে? এ শাস্তি এমন যে, মরেও নিস্তার নেই। এই তো সেদিন, ইসলামিক পিস টিভিতে আব্দুর রাজ্জাকের এক ওয়াজে বেগম রোকেয়াকে নারী জাতির কলঙ্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যুগে যুগেই অধিকারকামী মেয়েদের পুরুষরা বেশ্যা বলেছে, পতিতা বলেছে, জিভ কেটে নিয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, জীবন্ত গর্ভ চিরে সন্তান বের করে এনেছে, দেশান্তর করেছে। এবং আঘাত এসেছে সব সময় নিজেদের পরিবার থেকেই। এরাই তো তারা যারা কন্যাদের জীবন্ত কবর দিতো, সহমরণের নামে জীবন্ত চিতায় তুলে দিতো মেয়েদের। তাই বলে থেমেও তো কেউ থাকেনি। ইতিহাস তো যুগে যুগে আমাদের বলিদানেই লেখা হয়েছে। পুরুষতন্ত্রের আগুনে পুড়ে মরেছে যে সীতা, জোয়ান অব আর্ক আমি তো তাঁদেরই উত্তরনারী। আমাকে আর নতুন কী আগুনে জ্বালাবে ওরা? আমার পূর্বনারীদের বলিদান থেকেই তো শিখেছি, আগুন লাগা এই পৃথিবীতে পথ খুঁজে নিতে হবে আমাদেরকেই, নইলে পুড়ে মরতে হবে।
আমি তো সেই খনা, এই একাট্টা পুরুষতন্ত্র মেধা আর যোগ্যতায় পেরে না ওঠে যার জিহ্বা কেটে নিয়েছে। আমি সেই জোয়ান, যিনি সামান্য এক কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে ফরাসি সেনাবাহিনীর জন্য বিরল যুদ্ধজয় এনে দিয়েছিলেন, যাঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স জিতে নিয়েছিলো তাদের বেহাত হয়ে যাওয়া ভূমি; কিন্তু ১৯ বছর বয়সে ডাইনি অপবাদ দিয়ে এই বীরকন্যাকে পুড়িয়ে মেরেছে অকৃতজ্ঞ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। মিশরের হুদা শারাবীর মাঝেই তো আমার জন্ম, যাঁকে শৈশবেই বলি হতে হয়েছিলো পুরুষের হেরেম রাজনীতির। বিয়ে দেয়া হয়েছিলো তাঁর চেয়ে বড় তিনটি কন্যা সন্তানের পিতার সাথে। কিন্তু সেই হেরেম থেকেই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক মুক্ত নারী, মিশরের নারীমুক্তির প্রবক্তা।
তো, চাচা-চাচী, মামা-মামি, খালু-খালা, ভাই-ভাবী আর আপা-দুলাভাইরা, জেনে রাখুন, যতোই বিষ উগরানো হোক না কেন ফেসবুকের খোলা দেয়ালে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কানপড়া পড়িয়ে, আমি তা থোড়াই কেয়ার করি। যে সমাজের ভয় আমাকে দেখান আপনারা, সে সমাজ কবে আমি গ্রহণ করেছিলাম? আমার সমাজ তো আমিই তৈরি করেছি। আমি বর্জন করেছি ওই অশিক্ষিত বর্বর ধর্মান্ধদের সম্মানের অহঙ্কার আর আত্মশ্লাঘা। আমি বিচার করি আমার বর্তমানের, পুনর্বিচার করি অতীতের অপমানের। আমার সরলতা আর সহনশীলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করা গেছে এটা যেমন সত্য, তার চেয়েও অনেক বেশি সত্য আমার আজকের খারাপ হওয়া, আমার প্রতিবাদ, আমার প্রতিশোধ এবং আপনাদের ভাষায় অত্যাচারী আর অহঙ্কারী হওয়া। আজকাল খুব মনে হয়, আমি কেন আরো আগে থেকেই অহংকারী, উদ্ধত আর অত্যাচারী হইনি?
আজকে আমি জানি, বিষকে বিষের দাহ দিয়েই দহন করে মারতে হয়। পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে মুক্তি মিলবে? তাই আমি নিজেকে খনন করি বারবার। খুঁজে দেখি কি অসীম শক্তি ও ঐশ্বর্য ঘুমিয়ে আছে আমার শরীরে ও আত্মায়। কোন অশীক্ষিত বর্বর কুৎসিত পুরুষ পুঙ্গবের কি ক্ষমতা আছে সে ঐশ্বর্যের কিছুমাত্র সরায় !
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম