স্বাধীনতা দিবসে সমৃদ্ধ দেশগড়ার শপথ
আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। এদিন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মানুষকে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় নির্মম গণহত্যা। (এ বছর দিনটি সরকারিভাবে প্রথমবারের মতো ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়েছে।) তারা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পিলখানা, ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের বাসস্থানে হামলা চালায় এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বস্তি, টার্মিনালসহ জনবহুল এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। তাদের এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলে সারারাত। এই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। মূলত ২৬ মার্চ প্রত্যুষেই শুরু হয় বাংলার গণমানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ। বলা চলে নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তথা চূড়ান্ত লড়াই এই দিনই শুরু হয়।
তারপর হানাদারদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠে একের পর এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ। এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয় শরণার্থী হিসেবে। গঠিত হয় বঙ্গবন্ধুকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সেক্টর, মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী, মুজিব বাহিনীসহ বিভিন্ন মুক্তি ফৌজ। অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা চূড়ান্ত বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছি একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার জন্য এমন আত্মত্যাগ খুব কম জাতি করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সেদিন সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। সেই সময় ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ মুক্ত স্বদেশে পালিত হয় স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী। সেদিন ছিল দেশ গড়ার প্রেরণায় সবাই উজ্জীবিত। সদ্য স্বাধীন দেশটির উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সেদিন যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন। এরপর পর্যায়ক্রমে খন্দকার মুশতাক ও সামরিক একনায়করা দেশে দুঃশাসন কায়েম করে। যারা ছিল মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিতদেরই দোসর। এদের আমলেই দেশের পবিত্র সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত হয় ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা এখনও সক্রিয়। তারা বাংলাদেশে মূলত একটি ‘পাকিস্তানী মডেলের’ শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। তারা একসময় দেশ থেকে বঙ্গবন্ধু নাম-নিশানা মুছে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। বেতার, টেলিভিশনসহ সব সরকারী প্রচার মাধ্যমে তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম প্রচার নিষিদ্ধ করেছিল। তারপর রাজনীতির মারপ্যাঁচে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সরাসরি অংশীদারও হয়েছিল এই স্বাধীনতাবিরোধীরা। এতে তারা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও আখেরে সফল হয়নি, এদেশের মানুষ তাদের সফল হতে দেয়নি। এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এই দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে, যারা একদিন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ দিত, সেই কলঙ্কও এখন মুছে গেছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সমর শক্তির দিক থেকেও এগিয়েছে বাংলাদেশ। নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে দুটো অত্যাধুনিক সাবমেরিন। সবদিক দিয়েই এখন শুধু সামনে এগিয়ে চলার স্বপ্ন, সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন।
স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পরে একাত্তরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম আবার শুরু হয়ে তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী ও বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দায়মোচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা ছাড়া আমাদের জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত করা সম্ভব নয়। তাই এই বিচার সম্পন্ন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রাখার শপথ নিতে হবে।
আমরা এই মহান দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহকর্মী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী সকল নেতাকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত মা-বোনদের। যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, জীবনপণ শপথ নিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমরা এই দিবসে সেই দায়িত্বের কথা স্মরণ করছি। নতুন করে শপথ নিচ্ছি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ বঞ্চনাহীন উন্নত সমৃদ্ধ মুক্তিযদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার।
এইচআর/এমএস