গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
আমাদের বারবার ফিরতে হয় ১৯৭১-এ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, কারণ এখানেই আমাদের পরিচয়। কিন্তু এভাবে মু্ক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সংশয়ে থাকার কথা ছিল না। ইতিহাসকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ এর সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে যারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছে, ১৯৯৬ পর্যন্ত, তারা ইতিহাসের বিকৃতি জাতির উপর আরোপিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি কোন এক বড় দলের বড় নেত্রী পাকিস্তানি কায়দায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন আর তার ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা সেকথা চড়া গলায় বলে বেড়ান। এটি আর কিছু নয়, তাদের মনের গহীনে বাস করে পাকিস্তানি দর্শন এবং তাদের একটা প্রকল্প আছে বাস্তবায়নের। সে প্রকল্পের নাম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প।
এমন এক বাস্তবতায় আজ আবার আমাদের সামনে হাজির ২৫ মার্চ। ১৯৭১-এর এই দিনে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সব ধরনের আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির মুক্তির লড়াই। নয় মাসের যুদ্ধে ভারতীয মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বাঙালি পরাজিত করে পাকিস্তানিদের। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ, লাখ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস আজও বিশ্ব দরবারে গণহত্যার স্বীকৃতি পায়নি।
যারা ১৯৭৫-এর পর ক্ষমতায় বসেছিল, যারা যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে, নানা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে পুনর্বাসিত করেছে, তারা ইতিহাসই ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আজ সময় এসেছে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন ও বসনিয়া তাদের দেশে সংগঠিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করেছে। এখন সময় বাংলাদেশের। আমাদের জাতীয় সংসদে সম্প্রতি সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় সবাই আশাবাদী হয়ে উঠেছে। সংসদের প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে এখন থেকে গণহত্যার স্মরণে ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালন করা হবে।
তবে যেকথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্পের পক্ষে যারা, অর্থাৎ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ঐতিহাসিক জোট কিভাবে দেখবে এই উদ্যোগকে? জামায়াত-বিএনপি জোটকে নীতিহীন আদর্শহীন সুবিধাবাদী জোট বলা যায় না। একটা আদর্শের ঐক্য এখানে আছে অবশ্যই। নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে এই দুই দলের ফারাকটা আসলে কোথায়? আদৌ আছে কি? খুঁজে দেখতে হয়। তবে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রকে যেভাবে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা হয়েছে সেখানে কাদের ভূমিকা বেশি সেটাও মাথায় রাখতে হয়। ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে তাদের ‘নীতি-আদর্শ’ রক্ষার জন্যই এই প্রকার বোঝাপড়া অনিবার্য। তাই চাইলেই ছাড়া হয় না। পূর্ব-পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প তো মাঝপথে বন্ধ করা যায় না।
বিএনপি আর জামায়াতের স্থায়ী রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন ‘বোঝাপড়া’র বিশ্বাসযোগ্যতা আসলে অনেক পুরনো। আর তা জানতে কিছুটা পেছনে যেতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ হয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও। পাকিস্তানে থেকে যান এই দলের আমীর গোলাম আযম।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে নতুন রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার রাজনীতি। আর সেই ধারাতে গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ও ধর্ম ব্যবসার রাজনীতিকে বৈধতা দেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।
জামায়াত ও বিএনপির সম্পর্কটা তাই পাটিগণিত বা অংক নয়, এতে আছে গভীর ক্রিয়াশীল রসায়ন। জিয়াউর রহমান জামায়াতকে নিজের রাজনৈতিক জোটে রাখেননি। খালেদা জিয়া জোটের সদস্য শুধু করেননি, দু’জন চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীকে মন্ত্রীও বানিয়েছিলেন। যে নীতি-আদর্শকে ভিত্তি করে এই জোট বন্ধুত্ব, তার শেকড় অনেক গভীরে। আর এর সাথে জাতির ঘাড়ে নতুন উপদ্রব হেফাজতে ইসলাম, যার সাথে আপোস করে করে দিশেহারা এখন সরকারও।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময়ও এই রসায়নকে উপলব্ধি করতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। ধানের শীষ আর দাঁড়িপাল্লা এক নয়, সেটা সবাই জানেন। কিন্তু কোথাও ধানের শীষ আর দাঁড়িপাল্লার ভিন্নতাও চোখে পড়েনি। রাজনৈতিক সমীকরণে ভোটের পাটিগণিতে যেমন নজর আছে, আদর্শের রসায়নকেও কখনও কম করে দেখা হয়নি। এই রসায়ন কাজ না করলে পাটিগণিতের অংক ভোটব্যাংকে পড়ে না।
আজ বাংলাদেশে জিহাদের নামে যে সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের ভয় তার শুরুটা হয়েছে এই ভূখণ্ডে জামায়াতের মাধ্যমে। জামায়াতই বারবার ইসলামকে সাধারণ মানুষের সামনে, শান্তিতে বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক ধার্মিক বাঙালির সামনে মওদুদীবাদের জিহাদের কথা বলে খুনের রাজনীতিকে নিয়ে এসেছে।
যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তারও আগে ২৪টি বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকশিত করেছে, সে শক্তিকে নতুন করে ওঠে দাঁড়াতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যকে কাজে লাগাতে একমাত্র পথ একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা। বারবার একাত্তরের কথা বলা।
গণহত্যা কখনো মুছে যায় না কিংবা তামাদি হয়ে যায় না। আজ যখন আমরা জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করব, তখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বলতে হবে যে তোমার যে ব্যর্থতা ছিল, সেই ব্যর্থতা তোমাদের মোচন করতে হবে। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন, বসনিয়ার মতো বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষ থেকে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস