মুজিবের বাঙালি, বাঙালির মুজিব
‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ বা ‘বাঙালির মানসপুত্র’ যে নামেই ডাকি না কেন তবু যেন সব বলা হয়ে ওঠেনা, কী যেন কোথাও বাকি থেকে যায়। বাঙালি জাতির জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে আত্মসংগ্রাম রাজা শশাঙ্কের সময় থেকে শুরু তার কেবল সফল বাস্তবায়ন নয়, বাঙালি জাতির গৌরবময় আত্মপরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুদ্ধিমত্তা, সাহস আর সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে। কলমের কালিতে যত সহজে তা লেখা হলো এ মহাযাত্রার পথ মোটেও তেমন কুসুম কোমল ছিল না। আর তাই ৫৪ বছর বয়সের জীবনে কারাগারে কাটিয়েছেন ৪ হাজার ৬ শত ৮২ দিন পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তেই ছিল মৃত্যু আশঙ্কা।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ব্রিটিশ-ভারতের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে হাজার বছরের শৃঙ্খলিত বাঙালির এ মুক্তিদূত জন্ম নেন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আদায়ের দাবি ক্রমশ প্রখর হতে শুরু করে। ইতিহাস তাঁকে সংগ্রামী বা দেশপ্রেমিকরূপে তৈরি করেনি তিনি জন্মেইছেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নতুন ছন্দ সৃষ্টি করতে আর তাইতো স্কুল পড়ুয়া কিশোর মুজিবকে দেখা যায় স্কুল পরিদর্শনে আসা বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের পথ আগলে দাঁড়িয়ে ক্লাশ রুম আর হোস্টেলের ছাদ মেরামতের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে।
তিনি তৈরি করেছিলেন ইতিহাসের নিজস্ব গতিপথ যা মিলিত হয়েছিল সাফল্যের মহাসড়কে। তিনি বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে উঠবার দীক্ষা, প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে পুঁতে দিয়েছিলেন জাতীয়তাবোধের বীজ, স্বাধীনতার মন্ত্র আর তাইতো ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি কণ্ঠে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানের দম্ভ, বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলো তাঁর সগৌরব উপস্থিতি। অকুতোভয় এই স্বপ্নের কারিগর তাঁর নিজস্ব মেধা সাহস আর দেশপ্রেমের জোরে নির্মাণ করেছিলেন বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, নির্মাণ করেছিলেন বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র আবাস স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, রাজনীতির এ মহান কবি ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায় , চারিত্র্যিক উচ্চতায় ছিলেন সবার সেরা। দেশের স্বার্থের প্রশ্নে বরাবরই ছিলেন আপোসহীন আর তাই দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার প্রস্তাব তিনি ঘৃণাভরে কেবল ফিরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং পাকিস্তানি কুচক্রীমহলসহ সারা বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির সততা, দেশপ্রেম, শক্তি আর সামর্থ্যের বিজয়কেতন উড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন মহৎ ও ক্ষমাশীল হৃদয়ের অধিকারী, ছিলেন অন্যায় অপরাধের সাথে আপোসহীন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের অনেককেই তাই তিনি সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কেউই কিন্তু এ ক্ষমার আওতাধীন ছিল না। রাজনৈতিক মতবিরোধকে তিনি কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিণত করেননি। কেবল তাই নয় রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে অনেক রাজনৈতিকভাবে বিরোধী এমন পরিবারকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন।
অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন আর তাই আওয়ামী লীগের পিঠের উপর সাম্প্রদায়িকতার পাথর হয়ে চেপে থাকা ‘মুসলিম’ শব্দটিকে কেটে তিনি আওয়ামী লীগকে সকল ধর্মের রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন পাশাপাশি সকল ধর্মের অনুসারীরা যেন নির্বিঘ্নে তাঁদের আচার পালন করতে পারেন সেদিকেও তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি। অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল ‘সুস্থ -সবল -জ্ঞান সমৃদ্ধ -ভেদ বৈষম্যহীন মানুষের উন্নত বাংলাদেশ’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ তৈরি করতে। তাঁর সবটুকুই ছিল তাঁর দেশের, তাঁর বাঙালির।
‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’-এমন নির্দেশ আর কে কবে শুনেছে কোথায়? আর শোনা মাত্রই একাত্তর হয়ে উঠলো একটি জনযুদ্ধের গৌরবগাথা। তিনি বললেন,“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”-শব্দগুলো কানে পৌঁছা মাত্রই দেশের নারী, পুরুষ, শিশু, যুবার হৃদয়ে জ্বলে উঠলো জয়ের মশাল, তাঁরা জ্বলে উঠলেন বীর মুক্তিযোদ্ধার বেশে।
তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রথমেই একটি ব্যক্তিগত নোটবুকের ইংরেজি উদ্ধৃতি রয়েছে যার বাংলা অর্থ “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। এই হলেন তিনি, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্তের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
[email protected]
এইচআর/এমএস